শ্রীকৃষ্ণ লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
শ্রীকৃষ্ণ লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

মঙ্গলবার, ১১ আগস্ট, ২০২০

শুভ জন্মাষ্টমী : ভগবানের জন্ম কিভাবে সম্ভব?




♥ শুভ জন্মাষ্টমীর শুভেচ্ছা ♥
আজ ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথি, এই দিনে জন্ম হয়েছিল ভগবান শ্রীকৃষ্ণের, তাই একে জন্মাষ্টমী বলে ৷ জন্মাষ্টমী = জন্ম + অষ্ঠমী ৷ শ্রীকৃষ্ণ, যিনি বিশ্বজগতের পিতা, তিনি কিনা বসুদেব ও দেবকীর পুত্ররূপে জন্ম গ্রহণ করলেন? এ বড় অদ্ভূত সন্দেশ নয় কি? কি প্রয়োজন ছিল স্বয়ং সৃষ্টিকর্তার পৃথিবীতে জন্ম নেবার?

বাস্তবিকপক্ষে, ভগবানের নিজের তো কোন প্রয়োজন নাই পৃথিবীতে জন্ম নেবার, তবুও যে তিনি জন্ম নিলেন তা কেবল আমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে, মানবজাতির হিতকল্যাণ করার জন্য ৷ আমরা অধম, ধর্ম-কর্ম জানিনা, কে শেখাবে আমাদের? যদি বলো যে, তিনি কোন প্রবর্তক মহাপুরুষ পাঠিয়ে দিতে পারতেন, আমাদের শেখাবার জন্য ৷ কিন্তু বলো দেখি সেই প্রবর্তক মহাপুরুষ কার কাছ থেকে শিখে আমাদের শেখাবেন? তাই ভগবান হচ্ছেন আদিগুরু, তাই তিনি স্বয়ং মানুষরূপে অভিনয় করে মানুষকে শেখান ৷ “আপনি আচারিয়া ধর্ম লোকেরে শেখায়” ৷ ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নিজেই বলেছেন একথা -

“শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি যাহা যাহা আচরণ করেন, অপর সাধারণেও তাহাই করে । তিনি যাহা প্রামাণ্য বলিয়া বা কর্তব্য বলিয়া গ্রহণ করেন, সাধারণ লোকে তাহারই অনুবর্তন করে । হে পার্থ, ত্রিলোক মধ্যে আমার করণীয় কিছু নাই, অপ্রাপ্ত বা প্রাপ্তব্য কিছু নাই, তথাপি আমি কর্মানুষ্ঠানেই ব্যাপৃত আছি । হে পার্থ, যদি অনলস হইয়া কর্মানুষ্ঠান না করি, তবে মানবগণ সর্বপ্রকারে আমারই পথের অনুবর্তী হইবে । (কেহই কর্ম করিবে না) ।” (পবিত্র গীতা ৩/২১—২৩)

তিনি নিজের আবির্ভাব সম্পর্কে আরো বলেছেন -

অজোহপি সন্নব্যয়াত্মা ভূতানামীশ্বরোহপি সন্ ।
প্রকৃতিং স্যামধিষ্ঠায় সম্ভবাম্যাত্মমায়য়া ।।
— “আমি জন্মরহিত, অবিনশ্বর এবং সর্বভূতের ঈশ্বর হইয়াও স্বীয় প্রকৃতিতে অনুষ্ঠান করিয়া আত্মমায়ায় আবির্ভূত হই ।” (ঐ, ৪/৬)

ভগবান জন্মরহিত, অর্থাৎ তার জন্মের বাধ্যবাধকতা নাই, সাধারণ জীব পূর্বজন্মের সঞ্চিত কর্মফল ভোগের জন্য জন্ম নিতে বাধ্য, কিন্তু ভগবান জন্ম নেন ‘আত্মমায়ায়’ অর্থাৎ নিজ ইচ্ছায় ৷ কেন? উত্তর—

যদা যদাহি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত ।
অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্ ।।
— “হে ভারত ! যখনই যখনই ধর্মের গ্লানি এবং অধর্মের অভ্যুত্থান হয়, আমি সেই সেই সময়ে নিজেকে সৃষ্টি করি (দেহ ধারণপূর্বক অবতীর্ণ হই) ।” (ঐ, ৪/৭)

পরিত্রাণায় সাধূনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্ ।
ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে ।।
— “সাধুগণের পরিত্রাণ, দুষ্টদিগের বিনাশ এবং ধর্মসংস্থাপনের জন্য আমি যুগে যুগে অবতীর্ণ হই ।” (ঐ, ৪/৮)

সাধারণ লোকেরা জন্ম নিজ ইচ্ছা অনুসারে হয়না, হয় কর্মানুসারে, কারণ তারা কর্ম করে কর্মবন্ধনে আবদ্ধ হয় ৷ কিন্তু ভগবান জন্ম-কর্ম কেবল লোকশিক্ষার্থ, তিনি জন্ম-কর্ম করেও তাতে আবদ্ধ হননা ৷ তাই ভগবানের জন্ম কর্ম দিব্য অর্থাৎ অলৌকিক ৷

জন্ম কর্ম চ মে দিব্যমেবং যো বেত্তি তত্ত্বতঃ ।
ত্যক্ত্বা দেহং পুনর্জন্ম নৈতি মামেতি সোহর্জুন ।।
—“হে অর্জুন, আমার এই দিব্য জন্ম ও কর্ম যিনি তত্ত্বতঃ জানেন, তিনি দেহত্যাগ করিয়া পুনর্বার আর জন্মপ্রাপ্ত হন না - তিনি আমাকেই প্রাপ্ত হন ।” (ঐ, ৪/৯)

ভগবানের পক্ষে এই জগৎ এক রঙ্গমঞ্চ ৷ অভিনেতা যেমন নাট্যমঞ্চে বিভিন্ন পোশাক-পরিচ্ছেদ ধারণ করে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করে, ভগবানও তদ্রুপ বিভিন্ন নাম-রূপ ধারণ করে আবির্ভূত হয়ে অভিনয় (লীলা) করেন ৷ তার জন্ম-কর্ম লোকশিক্ষার্থ ও স্বীয় ভক্তজনকে আনন্দ প্রদানার্থ অভিনয় মাত্র ৷

শ্রীশুকদেব গোস্বামী তাই বলেছেন-
“হে রাজন্! অভিনেতা যেরুপ স্বরুপতঃ অবিকৃত থাকিয়াই রঙ্গমঞ্চে দর্শকগণের সমক্ষে বিবিধ জন্মমরণাদি লীলা অভিনয় করে, পরমাত্মা শ্রীকৃষ্ণের যাদবাদিকুলে আবির্ভাবতিরোভাবচেষ্টাও সেরুপ মায়াভিনয়মাত্র জানিবে ৷ বস্তুতঃ সেই পরমপুরুষ স্বয়ংই এই জগৎ সৃষ্টি করেন, এতে অবতরণ করেন ও বিহার করেন এবং লীলা শেষে নিজ স্বরুপে স্থিত হন ৷”
[ #শ্রীমদ্ভাগবত মহাপুরাণ ১১৷৩১৷১১]

প্রপঞ্চং নিষ্প্রপঞ্চোহ’পি বিড়ম্বয়সি ভূতলে ৷
প্রপন্নজনতানন্দসন্দোহং প্রথিতং বিভো ৷৷
“হে বিভো শ্রীকৃষ্ণ, তুমি প্রপঞ্চাতীত হয়েও ভক্তজনগণের আনন্দসমূহ বিস্তার করার জন্য ভূতলে প্রপঞ্চস্থ পুত্রাদিভাবের অনুকরণ করছো ৷” [#শ্রীমদ্ভাগবত মহাপুরাণ ১০৷১৪৷৩৭]

মমস্তস্মৈ ভগবতে কৃষ্ণায়ামলকীর্ত্তয়ে ৷
যো ধত্তে সর্ব্বভূতানামভবায়োশতীঃ কলাঃ ৷৷
“যে সর্ব্বেশ্বর ভগবান্ নিখিল জীবগণের সংসার-দুঃখের নিবারণার্থ কমনীয় বিগ্রহ-সমূহ ধারণে আবির্ভূত হন, সেই পবিত্রকীর্ত্তি ভগবান্ শ্রীকৃষ্ণকে আমি প্রণাম করি ৷” [শ্রীমদ্ভাগবত ১০৷৮৭৷৪০]


//ওঁ শ্রীকৃষ্ণার্পণমস্তু //

শনিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০১৮

শিব কতৃক ভগবান শ্রীকৃষ্ণের স্তব


শ্রীরূদ্র উবাচ
ত্বং হি ব্রহ্ম পরং জ্যোতির্গূঢ়ং ব্রহ্মণি বাঙ্ময়ে ৷
যং পশ্যন্তমলাত্মান আকাশমিব কেবলম্ ৷৷
(শ্রীমদ্ভাগবদ মহাপুরাণ ১০৷৬৩৷৩৪)
—“[হে পরমেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ!] বেদে দুর্বোধ্য শব্দের দ্বারা যাঁর বর্ণনা করা হয়েছে, যিনি জ্যোতিস্বরুপ এবং আকাশের ন্যায় সকল দোষ হতে অস্পৃষ্ট ও স্বাশ্রয়, তুমিই সেই পরমব্রহ্ম ৷ শুদ্ধচিত্ত সাধকগণ তোমাকে দর্শন করেন ৷”

দেবদত্তমিমং লব্ধা নৃলোকমজিতেন্দ্রিয়ঃ ৷
যো নাদ্রিয়েত ত্বৎপাদৌ স শোচ্যো হ্যাত্মবঞ্চকঃ ৷৷
(শ্রীমদ্ভাগবত মহাপুরাণ ১০৷৬৩৷৪১)
—“[হে ভগবান!] যে অজিতেন্দ্রিয় ব্যক্তি তোমার দেওয়া এই মনুষ্যদেহ লাভ করে তোমার চরণযুগল সমাদরে সেবা না করে, সে আত্মবঞ্চক ও অনুশোচনার পাত্র ৷”

অহং ব্রহ্মাথ বিবুধা মুনয়শ্চামলাশয়াঃ ৷
সর্বাত্মনা প্রপন্নাস্ত্বামাত্মানং শ্রেষ্ঠমীশ্বরম্ ৷৷
তং ত্বা জগৎস্থিত্যুদয়ান্তহেতুং
         সমং প্রশান্তং সুহৃদাত্মদৈবম্ ৷
অনন্যমেকং জগদাত্মকেতুং
          ভবাপবর্গায় ভজাম দেবম্ ৷৷
(শ্রীমদ্ভাগবত মহাপুরাণ ১০৷৬৩৷৪৩-৪৪)
—“[হে ভগবান!] আমি (শিব), ব্রহ্মা, দেবগণ ও শুদ্ধচিত্ত মুনিগণ সর্বোতভাবে প্রিয়তম পরমাত্মা ঈশ্বর তোমার শরণাগত হই ৷ হে দেব! তুমি জগতের সৃষ্টি স্থিতি প্রলয়ের হেতু, সম স্বভাব অতএব প্রশান্তস্বরুপ, সুহৃৎ, সমানাধিকশূণ্য ও জগদাত্মার আধার ৷ হে আরাধ্যদেব,  আমরা তোমাকে সংসার মুক্তির জন্য ভজনা করি ৷”
______________________

সত্ত্বে চ তস্মিন্ ভগবান্ বাসুদেবো
হ্যধোক্ষজো মে নমসা বিধীয়তে ৷৷
(শ্রীমদ্ভাগবত মহাপুরাণ ৪৷৩৷২৪)
মহাদেব সতীদেবীর নিকট বলিতেছেন—“সেই শুদ্ধ চিত্তের অন্তর্বাসী ভগবান বাসুদেবকেই আমি প্রণামাদি নিবেদন করি ৷”

রুদ্র উবাচ
যঃ পরঃ রহসঃ সাক্ষাৎ ত্রিগুণাজ্জীবসংজ্ঞিতৎ।
ভগবদন্তং বাসুদেবং প্রপন্নঃ স প্রিয়ো হি মে।।
(শ্রীমদ্ভাগবত মহাপুরাণ ৪৷২৪৷২৮)
 শ্রীরূদ্রদেব বলিলেন, “যে ব্যক্তি প্রকৃতি ও পুরূষের নিয়ন্তা গুহ্যাদপি গুহ্যস্বরূপ ভগবান বাসুদেবের শ্রীচরণে অনন্যভাবে শরণাগত হন তিনিই আমার প্রিয় ৷”

যৎপাদপঙ্কজরজঃ শিরসা বিভর্ত্তি -
শ্রীরজজঃ সগিরিশঃ সহ লৌকপালৈঃ ৷
(শ্রীমদ্ভাগবদ মহাপুরাণ ১০৷৫৮৷৩৮)
অর্থ— লক্ষীদেবী, মহাদেব ও ব্রহ্মা সহ সকল লোকপাল দেবতাগণ শ্রীকৃষ্ণের শ্রীচরণকমলের রেণু মস্তকে ধারণ করে থাকেন ৷

//ওঁ শ্রীকৃষ্ণার্পণমস্তু//


বুধবার, ২১ নভেম্বর, ২০১৮

ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বহুবিবাহ করেন কেন?




শাস্ত্রশিরোমণি শ্রীমদ্ভাগবত মহাপুরাণে শ্রীকৃষ্ণের যে-কয়েকজন স্ত্রীর নাম উল্লেখ পাওয়া যায় তাঁরা হচ্ছেন— রুক্মিণী, সত্যভামা, জাম্ববতী, কালিন্দী, ভদ্রা, সত্যা (নাগ্নজিতী), মিত্রাবিন্দা, লক্ষণা ও রোহিণী ৷ এছাড়াও তিনি ষোড়শসহস্র রাজকন্যাকে উদ্ধারপূর্বক স্ত্রীরুপে গ্রহণ করেছিলেন ৷
শ্রীকৃষ্ণ যে এত বিবাহ করলেন তার দুইটি কারণ—একটি রাজনৈতিক, অপরটি আধ্যাত্মিক ৷ তখন বিরাট ভারতে সামন্তরাজা রাজত্ব করতেন ৷ তাঁরা সর্বদাই বিবাদবিসংবাদে রত থাকতেন ৷ ফলে দেশের অখণ্ডতা নষ্টপ্রায় হয়েছিল ৷ শ্রীকৃষ্ণ এই রাজ্যের অখণ্ডতা সাধন ব্রতরুপে গ্রহণ করেছিলেন ৷ যারা অতীব দুর্দ্দান্ত, যেমন-জরাসন্ধ, শিশুপাল—তাদেরকে  তিনি শেষ করার ব্যবস্থা করেন ৷ যারা অপেক্ষাকৃত শান্ত, তাদের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে সকলকে একতাসূত্রে বন্ধনের চেষ্টা করেন ৷ রুক্মিণী বিদর্ভরাজকন্যা, নাগ্নজিতী কোশলরাজকন্যা, ভদ্রা কেকয়রাজকন্যা, লক্ষণা মদ্ররাজকন্যা—এদেরকে বিবাহ করে তিনি একটি প্রীতির সূত্র রচনা করেন ৷ ইহা রাজনৈতিক হেতু ৷
আর আধ্যাত্মিক দৃষ্টিতে, নিখিল বিশ্বে শ্রীকৃষ্ণই একমাত্র স্বামী ৷ জীবমাত্রই প্রকৃতি ৷ শ্রীকৃষ্ণ সকল জীবেরই পরম স্বামী ৷ তিনি সকলকে আপন বলে গ্রহণ করতে সর্বদা উৎসুক ৷ কিন্তু জীব তাঁকে ভুলে আছে বলে তিনি গ্রহণ করতে পারেন না ৷ যদি কোন ভাগ্যে কাহারও শ্রীকৃষ্ণে ভালোবাসা জাগ্রত হয়— শ্রীকৃষ্ণ তখন কালবিলম্ব না করে তাকে আপন জন করে নেন, কোন বাধাই মানেন না ৷ রুক্মিণী, কালিন্দী, মিত্রাবন্দা, নাগ্নজিতী, ভদ্রা, লক্ষণা— সকলেই অন্তরে শ্রীকৃষ্ণকে পতিরুপে কামনা করেছিলেন ৷ এমতবস্থায় সকল বাধা অতিক্রম করে তাঁদেরকে গ্রহণ করাই তাঁর ব্রত ৷ জাম্ববতী ও সত্যভামার পিতা নিজেদের অপরাধী মনে করে ক্ষমা পাওয়ার আশায় শ্রীকৃষ্ণকে নিজ নিজ কন্যা অর্পণ করেন বলে শ্রীকৃষ্ণও তাঁদেরকে গ্রহণ করতে বাধ্য হন ৷
নরকাসুর নামে এক অত্যাচারী রাজা ছিল ৷ তিনি বহু রাজকন্যা অপহরণ করে বন্দী করে রেখেছিল ৷ শ্রীকৃষ্ণ তাকে বধ করেন এবং তার ভবনে প্রবেশ করে বন্দী ষোড়শসহস্র রাজকন্যাকে উদ্ধার করেন ৷
“ঐ সকল রাজকন্যা শ্রীকৃষ্ণকে গৃহমধ্যে প্রবিষ্ট হতে দেখেই মোহিতা হয়ে পড়েছিল এবং সেই নরশ্রেষ্ঠ শ্রীকৃষ্ণকে মনে মনে দৈবকৃত উপস্থাপিত অভীষ্ট পতি বলে বরণ করেছিল ৷ তাঁরা সকলে পৃথক পৃথক ভাবে ‘ইনি যেন আমার পতি হন, বিধাতা তার অনুমোদন করুন’ এইরুপ চিন্তা করে অনুরাগভরে ভগবান্ শ্রীকৃষ্ণে চিত্ত সমাহিত করেছিল” (শ্রীমদ্ভাগবত ১০৷৫৯৷৩৩-৩৪) ৷
এই হেতু শ্রীকৃষ্ণও তাঁদেরকে পত্নীত্বে বরণ করে তাঁদের প্রতি অনুগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন ৷ শ্রীকৃষ্ণকে পতিরুপে কামনা করে নাই, এমন কাউকেও তিনি পত্নীরুপে গ্রহণ করেন নাই; জগৎপতির ইহাই কর্তব্য ৷ এই কার্য্যের অনুকরণ কেউই করতে পারেন না ৷ কারণ শ্রীকৃষ্ণ ষোড়শসহস্র গৃহে ষোড়শসহস্র মূর্তি ধারণ করে তাঁদেরকে বিবাহ করেছিলেন ও একই সময়ে প্রত্যেকের গৃহে অবস্থিত থেকে তাঁদের প্রীতি বিধান করিতেন ৷ প্রমাণস্বরূপ (শ্রীমদ্ভাগবত ১০৷৫৯৷৪২)-
অথো মুহূর্ত একস্মিন্ নানাগারেষু তাঃ স্ত্রীয়ঃ ৷
যথোপয়েমে ভগবান তাবদ্রূপধরোহ’ব্যয়ঃ ৷৷
—‘যিনি সকল অবস্থায় পরিপূর্ণ সেই ভগবান্ শ্রীকৃষ্ণ নরকাসুরের অন্তঃপুর হতে যত রাজকন্যা আনয়ন করেছিলেন, তত রূপ ধারণ করে নানা গৃহে একই শুভলগ্নে তাঁদেরকে বিধি অনুসারে বিবাহ করেন ৷’
ষোড়শসহস্র শরীর ধারণরুপ অদ্ভূত কায়বূহ্য বিস্তার করার সামর্থ্য নিখিল বিশ্বে যোগেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ভিন্ন আর কারো নাই ৷

আরেকটি কথা, লোকমুখে প্রচলিত আছে যে ‘কৃষ্ণ কেমন?—যে যেমন’ অর্থাৎ যে যেমন ধরনের লোক, সে কৃষ্ণকেও ঠিক তেমনই মনে করে ৷ এই কারণেই চরিত্রহীন ব্যক্তিরা মন্তব্য করে যে, কৃষ্ণের এত বিবাহের একমাত্র কারণ তাঁর অতিরিক্ত কামুকতা ৷ কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ যে কামুক পুরুষ ছিলেন না তার একটি ছোট্ট প্রমাণ দিলাম, বুদ্ধিমানেরা বুঝে নিবেন ৷

‘কৃষ্ণপ্রিয়াগণ সংখ্যায় ষোড়শ সহস্র ছিলেন; তথাপি তাঁহারা কামশরের দ্বারা এবং কামশাস্ত্রোক্ত অন্যান্য উপায়সমূহের দ্বারাও ভগবান্ শ্রীকৃষ্ণের মন বিক্ষোভিত করিতে সমর্থা হন নাই ৷’ (শ্রীমদ্ভাগবত ১০/৬১/৪)

শুক্রবার, ২০ এপ্রিল, ২০১৮

ভগবান শ্রীকৃষ্ণের দামবন্ধন লীলা তাৎপর্য বিশ্লেষণ




গোপাল দধির ভাণ্ড ভাঙিয়াছেন ৷ মা যশোদা ক্রুদ্ধা হইয়াছেন ৷ পলায়নপর গোপালকে ছুটিয়া গিয়া হাত ধরিয়াছেন ৷ তারপর বাঁধিয়া রাখিতে ইচ্ছা করিয়াছেন ৷ রজ্জু দিয়া গোপালের কটিদেশ বন্ধন করিয়া একটি উদূখলের সঙ্গে বাঁধিয়া রাখিতে মা যশোদা মনে মনে ঠিক করিয়াছেন ৷ গৃহ হইতে রজ্জু আনাইয়া বাঁধিতে আরম্ভ করিলেন ৷ গোপাল বারংবার বলিতে লাগিলেন, “মা, আমায় বেঁধো না ৷” মা গোপালের কথা না শুনিয়া বাঁধিতে চেষ্টা করিতে লাগিলেন ৷ তাঁহার রজ্জুটা কটিবেষ্টন করিতে দুই আঙুল ছোট হইল ৷ মা ঐ রজ্জুর সঙ্গে আর একটা রজ্জু বাঁধিলেন ৷ তারপরও দুই আঙ্গুল ছোট হইল ৷ ঘরে যত বন্ধনযোগ্য দড়ি ছিল— একটার পর একটা একত্র বন্ধন করিয়াও গোপালের কটিদেশ বন্ধন করিতে সক্ষম হইলেন না ৷ প্রত্যেকবারই কম পড়িতে লাগিল ৷ মায়ের জেদ চাপিয়া গেল ৷ পাশের বাড়ীর গোপীদের ঘরে যত দড়ি ছিল চাহিয়া আনাইয়া যোগ করিতে লাগিলেন কিন্তু কি আশ্চর্য! প্রত্যেকবারই একই অবস্থা, দুই আঙ্গুল কম ৷ মা কিছুই বুঝিতে পারিতেছেন না ৷
এখানে দুইটি বিষয় চিন্তনীয় ৷ কোলের শিশু গোপালকে মা বাঁধিতে পারিতেছেন না কেন? আর একটি বিষয় প্রত্যেকবার দুই আঙ্গুল পরিমাণ ছোট কেন?
প্রথমটির উত্তর শুকদেব বলিয়াছেন—
“ন চান্তর্ন বহির্যস্য ন পূর্বং নাপি চাপরম্ ৷
পূর্বাপরং বহিশ্চান্তর্জগতো যো জগচ্চ যঃ ৷৷”
                                                 (ভাগবত, ১০/৯/১৩)
যাহার অন্তর বাহির নাই, অগ্রপশ্চাৎ নাই, যিনি জগন্ময়— মা তাঁহাকে কেবল কোলের শিশু মনে করিয়া বাঁধিতে প্রয়াস পাইতেছেন ৷ শুকদেবের কথার তাৎপর্য এই, গোপাল যখন মায়ের কোলে শিশুটি ঠিক তখনই তিনি বিশ্বব্যাপী ভূমা ৷ তিনি যখন ছোট তখনই বড় ৷ তিনি যুগপৎ সমীম ও অসীমরুপে অবস্থান করেন ৷

আরেকটি প্রশ্ন, প্রতিবার দুই আঙুল পরিমাণ ছোট কেন? এক আঙুল সাধকের সাধন-তপস্যা, আরেক আঙুল ভগবানের কৃপা ৷ প্রথমত সাধক সাধনার দ্বারা ভগবানকে পেতে চাইবেন, কিন্তু সাধন-তপস্যায় একসময় তিনি  মা যশোদার মতো ক্লান্ত হয়ে পড়িবেন, দেখিবেন যে সাধনার দ্বারা ভগবানকে কিছুতেই বাঁধা যাইতেছে না, তখন ভগবান ভক্ত-সাধককে কৃপা করিয়া তিনি নিজেই তার কাছে ধরা দিবেন ৷

নায়মাত্মা প্রবচনেন লভ্যো
            ন মেধয়া ন বহুনা শ্রুতেন ৷
যমেবৈষ বৃণুতে তেন লভ্য-
       স্তস্যৈষ আত্মা বিবৃণুতে তনুং স্বাম্ ।। কঠঃ ১৷২৷২৩
—“এই পরমাত্মাকে শাস্ত্র ব্যাখ্যান দ্বারা লাভ করা যায় না, মেধা দ্বারাও নয়, বহু শাস্ত্র শ্রবণের দ্বারাও নয় ৷ যাহাকে এই পরমাত্মা বরণ করিয়া নেন, তাহারই লভ্য, তাহার নিকটেই তিনি মেলে ধরেন আপন তনু ৷”

ইহাই বেদান্তের মর্মকথা!


৷৷ ওঁ শ্রীকৃষ্ণার্পণমস্তু ৷৷


শনিবার, ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৭

ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কি গীতা বিস্মৃত হন?



কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধকালে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনের নিকট যে গীতামৃত কীর্ত্তণ করেছিলেন, সেই পবিত্র গীতাজ্ঞান অর্জুন ভুলে গিয়ে অশ্বমেধপর্বে শ্রীকৃষ্ণের নিকট পুণরায় শুনতে চান । তখন ভগবান শ্রীকৃষ বলেন, “তুমি নিশ্চয় দুর্ম্মেধা, তাই আমার সেই সকল কথা স্মরণ রাখিতে পার নাই ৷” তিনি আরও বলিলেন—
পরম হি ব্রহ্ম কথিতং যোগযুক্তেন তন্ময়া।
ইতিহাসস্তু বক্ষ্যামি তস্মিন্নর্থে পুরাতনম্ ৷৷
অর্থাৎ— ‘তৎকালে আমি যোগযুক্ত হইয়া পরব্রহ্মের বিষয় বলিয়াছিলাম, এখন সেই বিষয়ে প্রাচীন বৃত্তান্ত বলিতেছি ৷’
(মহাভারত, আশ্বমেধিকপর্ব্ব, অনুগীতা)

লক্ষ্যণীয় যে, যোগ শব্দের নানা প্রকার অর্থ আছে ৷ এখানে কোন অর্থে যোগ-শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে তা স্পষ্ট লেখা আছে—
‘যোগযুক্তেন ঐক্যাগ্রসমন্বিতেন’ (ভারতকৌমুদী টীকা)
অর্থাৎ এখানে যোগযুক্ত অর্থ একাগ্রতার সহিত ৷
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যুদ্ধকালে অর্জুনকে যুদ্ধে প্রবৃত্ত করার জন্য যে সকল বাক্য ব্যয় করেছিলেন একাগ্রতার সহিত, তা আবার এখন পুণরোক্তি করবেন কিসের নিমিত্ত? তাছাড়া অর্জুন যে গীতা ভুলে গেছেন তার দুর্বল মেধাবশত, তাকে পুণরায় গীতা বললেও সে যে আবার ভুলে যাবে না তারই বা গ্যারান্টি কি? তাই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বললেন, “আমি সেই বিষয়ে তোমাকে প্রাচীন বৃত্তান্ত বলিতেছি ৷” অর্থাৎ সেই গীতাজ্ঞানই তিনি প্রকারন্তরে ইতিহাস গল্পের মাধ্যমে বলিবেন ৷ কেননা গল্পের মাধ্যমে যদি খুব কঠিন বিষয়ও আলোচনা করা হয়, তবে সেটা খুব সহজেই মনে রাখতে পারা যায়। এই জন্যই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সেই উপায়টি অবলম্বন করেন। পরবর্তীতে গীতাজ্ঞান জ্ঞান এইরুপে ভিন্নভাবে কথিত হওয়ায় একে ‘অনুগীতা’ বলা হয় ৷ অনুগীতা প্রদানের পর ভগবান বলিলেন—
পূর্বমপ্যেতদেবোক্তং যুদ্ধকাল উপস্থিতে।
ময়া তব মহাবাহো তস্মাদত্র মনঃ কুরু।।
(অশ্বমেধিকপর্ব, ৬৬/৭)
“মহাবাহু! পূর্বেই কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধের সময় উপস্থিত হইলে, আমি তোমার নিকট ভগবদগীতাস্বরূপ এই বিষয়ই বলিয়াছিলাম, অতএব তুমি এই বিষয়ে মনোনিবেশ কর।”
অতএব এইটা সুস্পষ্ট যে ভগবান যদিও সরাসরি ভাবে অর্জুনকে পুনরায় গীতা জ্ঞান প্রদান করতে অসম্মতি জানান তবুও ইতিহাসের মাধ্যমে ভগবান এখানে গীতার বিষয়ই তুলে ধরেছেন, যাতে করে অর্জুন সেই জ্ঞানটা আয়ত্ত করতে পারে ৷
.
এইরুপে সমগ্র বিষয়টি বুঝতে না পেরে অন্ধের হস্তিদর্শনের ন্যায় কিছু অকাল-কুষ্মান্ড মূর্খ বলে থাকে যে, শ্রীকৃষ্ণ সাধারণ মানুষ মাত্র, তিনি গীতা বিস্মৃত হয়েছিলেন, গীতা তাঁহার নিজস্ব উক্তি নয়, তিনি পরমাত্মার সহিত যোগযুক্ত হয়ে উহা বলেছিলেন ৷ সেই মূর্খদের উদ্দেশ্যে বলিতেছি, আপনারা যে অশ্বমেধপর্বের রেফারেন্স দিয়ে ঐসকল কথা বলিতেছেন, ঐ অশ্বমেধপর্বেই যুধিষ্টির শ্রীকৃষ্ণকে উদ্দেশ্য করে কি বলিতেছে দেখুন—
“হে বিশ্বকর্মন! হে বিশ্বাত্মন! হে বিশ্বশ্রেষ্ঠ! আমি মনে মনে তোমাকে যেরূপ ধারণা করি, কার্য্যদ্বারাও তোমাকে সেইরুপই জানিতেছি।”
“প্রভু মধুসূদন! অগ্নি সর্বদাই তোমার তেজ হইতে উৎপন্ন হন এবং রতি তোমারই ক্রিয়াস্বরূপা, আর স্বর্গ ও মর্ত তোমারই মায়া।”
(মহাভারত, অাশ্বমেধিকপর্ব ৬৭/৮-৯)
.
অতএব—
যশ্চ মানুষমাত্রোহ‘য়মিতি ব্রুয়াৎ স মন্দধীঃ ৷
হৃষীকেশমবিজ্ঞানাত্তমাহু পুরষাধমম্ ৷৷
—“যে লোক অজ্ঞানবশতঃ এই হৃষীকেশকে মানুষমাত্র বলিবে সে মন্দবুদ্ধি, সকলে তাকে ‘নরাধম’ বলিবে ৷”
(মহাভারত, ভীষ্মপর্ব, ৬৫/১৯)
.
সবশেষে—
সারথ্যমর্জুনস্যাজৌ কুর্ব্বন গীতামৃতং দদৌ ৷
লোকত্রয়োপকারায় তস্মৈ ব্রহ্মাত্মনে নমঃ ৷৷
“যিনি যুদ্ধে অর্জুনের সারথ্য করিতে প্রবৃত্ত হইয়া, ত্রিভূবনের উপকার করিবার জন্য অর্জুনকে গীতামৃত দান করিয়াছেন সেই পরমব্রহ্মরূপী কৃষ্ণকে নমষ্কার করি।”
(মহাভারত, শান্তিপর্ব ৪৬/১০৬)

[Reference book: মহাভারত, হরিদাশ সিদ্ধান্তবাগীশ]

বৃহস্পতিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০১৭

ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অন্তর্ধান লীলা


কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ শেষে শোকসন্তপ্তা গান্ধারী শ্রীকৃষ্ণকে কম্বোজরাজ, মগধরাজ জয়ৎসেন, রুচিরাঙ্গদধারী কেকয় দেশীয় পাঁচ ভ্রাতা, পাঞ্চালরাজ দ্রুপদ, চেদিদেশাধিপতি মহাবীর ধৃষ্টকেতু প্রভৃতির মৃতদেহ এবং মৃতদেহের পার্শ্বে  তাহাদের রমণীগণ ও আত্মীয়-স্বজন কিরুপ শোক করিতেছে সে দৃশ্য দেখাইয়া অনেক বিলাপ করিলেন ৷ গান্ধারী বহুবিধ বিলাপ করিয়া (বাকি অংশ কালীপ্রসন্ন সিংহের অনুবাদ হতে সরাসরি উদ্ধৃত—) দুঃখশোকে একান্ত অধীর ও হতজ্ঞান হইয়া ভূতলে নিপতিত হইলেন এবং কিয়ৎক্ষণ পরে ক্রোধভরে বাসুদেবের প্রতি দোষারোপ করিয়া কহিলেন, “জনার্দ্দন! যখন কৌরব ও পাণ্ডবগণ পরস্পরের ক্রোধানলে পরস্পর দগ্ধ হয়, তৎকালে তুমি কি নিমিত্ত তদ্বিষয়ে উপেক্ষা প্রদর্শন করিলে? তোমার বহুসংখ্যক ভৃত্য ও সৈন্য বিদ্যমান আছে; তুমি শাস্ত্রজ্ঞানসম্পন্ন, বাক্যবিশারদ ও অসাধারণ বলবীর্য্যশালী, তথাপি ইচ্ছা পূর্ব্বক কৌরবগণের বিনাশে উপেক্ষা প্রদর্শন করিয়াছ। অতএব তোমারে অবশ্যই ইহার ফলভোগ করিতে হইবে। আমি পতিশুশ্রূষা দ্বারা যে কিছু তপঃসঞ্চয় করিয়াছি, সেই নিতান্ত দুর্লভ তপঃপ্রভাবে তোমারে অভিশাপ প্রদান করিতেছি যে, তুমি যেমন কৌরব ও পাণ্ডবগণের জ্ঞাতি বিনাশে উপেক্ষা প্রদর্শন করিয়াছ, তেমনি তোমার আপনার জ্ঞাতিবর্গও তোমা কর্ত্তৃক বিনষ্ট হইবে। অতঃপর ষট্‌ত্রিংশৎ বর্ষ সমুপস্থিত হইলে তুমি অমাত্য, জ্ঞাতি ও পুত্ত্রহীন এবং বনচারী হইয়া অতি কুৎসিত উপায় দ্বারা নিহত হইবে। তোমার কুলরমণীগণও ভরতবংশীয় মহিলাগণের ন্যায় পুত্ত্রহীন ও বন্ধুবান্ধব বিহীন হইয়া বিলাপ ও পরিতাপ করিবে।”

তখন মহামতি বাসুদেব গান্ধারীর মুখে এই কথা শ্রবণ করিয়া হাস্যমুখে তাঁহারে কহিলেন, “দেবি! আমা ব্যতিরেকে যদুবংশীয়দিগকে বিনাশ করে, এমন আর কেহই নাই। আমি যে যদুবংশ ধ্বংস করিব, তাহা বহুদিন অবধারণ করিয়া রাখিয়াছি। আমার যাহা অবশ্য কর্ত্তব্য, এক্ষণে আপনি তাহাই কহিলেন। যাদবেরা মনুষ্য বা দেব দানবগণের বধ্য নহে; সুতরাং তাঁহারা পরস্পর বিনষ্ট হইবেন।” বাসুদেব এই কথা কহিবামাত্র পাণ্ডবেরা ভীত ও উদ্বিগ্ন হইয়া প্রাণ ধারণ বিষয়ে এককালে হতাশ হইলেন।
(স্ত্রীপর্ব, স্ত্রীবিলাপপর্ব্বাধ্যায়)


এরপর, যদুবংশের বিনাশ আরম্ভ হইলে, মহাত্মা বলরাম অন্তর্ধান হইলেন ৷ “তখন সর্ব্বজ্ঞ দিব্যচক্ষু ভগবান্ বাসুদেব জ্যেষ্টভ্রাতা দেহত্যাগ করিলেন বিবেচনা করিয়া চিন্তাকুলিতচিত্তে সেই বিজন পথে পরিভ্রমণ করিতে করিতে ভূতলে উপবেশন করিলেন। ঐ সময় পূর্ব্বে গান্ধারী তাঁহাকে যাহা কহিয়াছিলেন এবং তিনি উচ্ছিষ্ট পায়স পদতলে লিপ্ত না করাতে দুর্ব্বাসা যে সমুদায় বাক্য প্রয়োগ করিয়াছিলেন, সেই সমুদায় তাঁহার স্মৃতিপথে সমুদিত হইল। তখন তিনি নারদ, দুর্ব্বাসা ও কণ্বের বাক্য প্রতিপালন, তাঁহার স্বর্গগমনবিষয়ে দেবতাদিগের সন্দেহভঞ্জন ও ত্রিলোকপালন করিবার নিমিত্ত তাঁহাকে মর্ত্ত্যলোক পরিত্যাগ করিতে হইবে, বিবেচনা করিয়া ইন্দ্রিয়সংযম ও মহাযোগ অবলম্বন পূর্ব্বক ভূতলে শয়ন করিলেন। ঐ সময় জরানামক ব্যাধ মৃগবিনাশবাসনায় সেই স্থানে সমাগত হইয়া দূর হইতে যোগাসনে শয়ান কেশবকে অবলোকন পূর্ব্বক মৃগ জ্ঞান করিয়া, তাঁহার প্রতি শর নিক্ষেপ করিল।
ঐ শর নিক্ষিপ্ত হইবামাত্র উহা দ্বারা হৃষীকেশের পদতল বিদ্ধ হইল। তখন সেই ব্যাধ মৃগগ্রহণবাসনায় সত্বরে তথায় উপস্থিত হইয়া দেখিল, এক অনেকবাহুসম্পন্ন পীতাম্বরধারী যোগাসনে শয়ান পুরুষ তাহার শরে বিদ্ধ হইয়াছেন। লুব্ধক তাঁহাকে দর্শন করিবামাত্র আপনাকে অপরাধী বিবেচনা করিয়া, শঙ্কিতমনে তাঁহার চরণে নিপতিত হইল। তখন মহাত্মা মধুসূদন তাহাকে আশ্বাস প্রদান পূর্ব্বক অচিরাৎ আকাশমণ্ডল উদ্ভাসিত করিয়া স্বর্গে গমন করিলেন।
[[শ্রীকৃষ্ণ কি বলে ব্যাধকে আশ্বস্ত করেছিলেন তা ব্যাসদেব মহাভারতে লিখেন নাই, কিন্তু পরবর্তীতে ভাগবতে লেখেন— ভগবান্ শ্রীকৃষ্ণ তখন সেই ব্যাধকে সম্বোধনপূর্বক বলিলেন, “ওহে জরা! তোমার ভয় নাই ৷ এ সমস্ত আমারই ইচ্ছায় ঘটিয়াছে; ইহাতে তোমার কোন অপরাধ নাই ৷ অতএব পুণ্যবান ব্যক্তিগণ বহু সৎকর্মের ফলে যে স্বর্গলোকে গমন করিয়া থাকেন, তুমি আমার অনুগ্রহে সেই সুরপুরীতে গমন কর ৷” (শ্রীমদ্ভাগবত, ১১/৩০/৩৯) ]]
ঐ সময় ইন্দ্র, অশ্বিনীকুমারদ্বয় এবং রুদ্র, আদিত্য, বসু, বিশ্বদেব, মুনি, সিদ্ধ, গন্ধর্ব্ব ও অপ্সরোগণ তাঁহার প্রত্যুদ্গমনার্থ নির্গত হইলেন; তখন ভগবান্ নারায়ণ তাঁহাদের কর্ত্তৃক সৎকৃত হইয়া তাঁহাদের সহিত স্বীয় অপ্রমেয় স্থানে সমুপস্থিত হইলেন। দেবতা, মহর্ষি, সিদ্ধ, চারণ, গন্ধর্ব্ব, অপ্সরা ও সাধ্যগণ তাঁহার যথোচিত পূজা করিতে লাগিলেন; মুনিগণ ঋগ্বেদপাঠ ও গন্ধর্ব্বগণ সংগীত দ্বারা তাঁহার স্তব করিতে আরম্ভ করিলেন এবং দেবরাজ ইন্দ্র আহ্লাদিতচিত্তে তাঁহার অভিনন্দনে প্রবৃত্ত হইলেন।” (মৌসলপর্ব, অধ্যায়-৪)


শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে পূর্বেই খবর পাঠিয়েছিলেন ৷ অর্জুন সংবাদ পেয়ে সেখানে এসে কৃষ্ণের পিতা বসুদেবের সাথে সাক্ষাৎ করেন ৷ শোকাকুল বসুদেব অর্জুনের কাছে বহু বিলাপ করেন ৷ তিনি অর্জুনকে বলেন, “তুমি, দেবর্ষি নারদ ও অন্যান্য মহর্ষিগণ যাহারে সনাতন দেবদেব বলিয়া কীর্ত্তণ করিয়া থাক, তিনি এক্ষণে স্বচক্ষে জ্ঞাতিবধ প্রতক্ষ্য করিয়া উপেক্ষা করিলেন ৷ বোধহয়, গান্ধারী ও ঋষিগণের বাক্য অন্যথা করিতে তাঁহার বাসনা হয় নাই ৷ তোমার পৌত্র পরীক্ষিৎ অশ্বথামার ব্রহ্মাস্ত্র দ্বারা দগ্ধ হইলে, তিনিই তাহার জীবনদান করিয়াছিলেন, কিন্তু এক্ষণে স্বীয় পরিজনদিগকে রক্ষা করিতে তাঁহার বাসনা হইল না ৷” (মৌসলপর্ব, অধ্যায়-৬)

পরে ব্যাসদেব অর্জুনকে বলেছিলেনঃ “বৃষ্ণি ও অন্ধকবংশীয় মহারথগণ ব্রহ্মশাপে দগ্ধ হইয়াছে; অতএব তাহাদিগের নিমিত্ত তোমার শোক করা কর্তব্য নহে ৷ ঐ বীরগণের নিধন অবশ্যম্ভাবী বলিয়া মহাত্মা বাসুদেব উহা নিবারণে সমর্থ হইয়াও নিবারণে উপেক্ষা করিয়াছেন ৷ তিনি মনে করিলে মহর্ষিশাপখন্ডের কথা দূরে থাকুক, এই স্থাবর-জঙ্গমাত্মক বিশ্বসংসারকেও অন্যরুপ নির্মাণ করিতে পারেন ৷ সেই পতিতপাবন কেবল পৃথিবীর ভারাবতরণ করিবার নিমিত্তই বসুদেবের গৃহে উৎপন্ন হইয়াছিলেন ৷” (মৌসলপর্ব, অধ্যায়-৮)



                     (তথ্যসূত্রঃ মহাভারত, কালীপ্রসন্ন সিংহ অনুদিত)

সাম্প্রতিক পোস্ট

পুরুষ—কৃষ্ণ ৷৷ প্রকৃতি—রাধা

 পুরুষ—কৃষ্ণ ৷৷ প্রকৃতি—রাধা ======================= যোগেনাত্মা সৃষ্টিবিধৌ দ্বিধারূপো বভূব সঃ ৷ পুমাংশ্চ দক্ষিণার্ধাঙ্গো বামাঙ্গঃ প্রকৃতিঃস্...

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ