বৃহস্পতিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০১৭

ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অন্তর্ধান লীলা


কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ শেষে শোকসন্তপ্তা গান্ধারী শ্রীকৃষ্ণকে কম্বোজরাজ, মগধরাজ জয়ৎসেন, রুচিরাঙ্গদধারী কেকয় দেশীয় পাঁচ ভ্রাতা, পাঞ্চালরাজ দ্রুপদ, চেদিদেশাধিপতি মহাবীর ধৃষ্টকেতু প্রভৃতির মৃতদেহ এবং মৃতদেহের পার্শ্বে  তাহাদের রমণীগণ ও আত্মীয়-স্বজন কিরুপ শোক করিতেছে সে দৃশ্য দেখাইয়া অনেক বিলাপ করিলেন ৷ গান্ধারী বহুবিধ বিলাপ করিয়া (বাকি অংশ কালীপ্রসন্ন সিংহের অনুবাদ হতে সরাসরি উদ্ধৃত—) দুঃখশোকে একান্ত অধীর ও হতজ্ঞান হইয়া ভূতলে নিপতিত হইলেন এবং কিয়ৎক্ষণ পরে ক্রোধভরে বাসুদেবের প্রতি দোষারোপ করিয়া কহিলেন, “জনার্দ্দন! যখন কৌরব ও পাণ্ডবগণ পরস্পরের ক্রোধানলে পরস্পর দগ্ধ হয়, তৎকালে তুমি কি নিমিত্ত তদ্বিষয়ে উপেক্ষা প্রদর্শন করিলে? তোমার বহুসংখ্যক ভৃত্য ও সৈন্য বিদ্যমান আছে; তুমি শাস্ত্রজ্ঞানসম্পন্ন, বাক্যবিশারদ ও অসাধারণ বলবীর্য্যশালী, তথাপি ইচ্ছা পূর্ব্বক কৌরবগণের বিনাশে উপেক্ষা প্রদর্শন করিয়াছ। অতএব তোমারে অবশ্যই ইহার ফলভোগ করিতে হইবে। আমি পতিশুশ্রূষা দ্বারা যে কিছু তপঃসঞ্চয় করিয়াছি, সেই নিতান্ত দুর্লভ তপঃপ্রভাবে তোমারে অভিশাপ প্রদান করিতেছি যে, তুমি যেমন কৌরব ও পাণ্ডবগণের জ্ঞাতি বিনাশে উপেক্ষা প্রদর্শন করিয়াছ, তেমনি তোমার আপনার জ্ঞাতিবর্গও তোমা কর্ত্তৃক বিনষ্ট হইবে। অতঃপর ষট্‌ত্রিংশৎ বর্ষ সমুপস্থিত হইলে তুমি অমাত্য, জ্ঞাতি ও পুত্ত্রহীন এবং বনচারী হইয়া অতি কুৎসিত উপায় দ্বারা নিহত হইবে। তোমার কুলরমণীগণও ভরতবংশীয় মহিলাগণের ন্যায় পুত্ত্রহীন ও বন্ধুবান্ধব বিহীন হইয়া বিলাপ ও পরিতাপ করিবে।”

তখন মহামতি বাসুদেব গান্ধারীর মুখে এই কথা শ্রবণ করিয়া হাস্যমুখে তাঁহারে কহিলেন, “দেবি! আমা ব্যতিরেকে যদুবংশীয়দিগকে বিনাশ করে, এমন আর কেহই নাই। আমি যে যদুবংশ ধ্বংস করিব, তাহা বহুদিন অবধারণ করিয়া রাখিয়াছি। আমার যাহা অবশ্য কর্ত্তব্য, এক্ষণে আপনি তাহাই কহিলেন। যাদবেরা মনুষ্য বা দেব দানবগণের বধ্য নহে; সুতরাং তাঁহারা পরস্পর বিনষ্ট হইবেন।” বাসুদেব এই কথা কহিবামাত্র পাণ্ডবেরা ভীত ও উদ্বিগ্ন হইয়া প্রাণ ধারণ বিষয়ে এককালে হতাশ হইলেন।
(স্ত্রীপর্ব, স্ত্রীবিলাপপর্ব্বাধ্যায়)


এরপর, যদুবংশের বিনাশ আরম্ভ হইলে, মহাত্মা বলরাম অন্তর্ধান হইলেন ৷ “তখন সর্ব্বজ্ঞ দিব্যচক্ষু ভগবান্ বাসুদেব জ্যেষ্টভ্রাতা দেহত্যাগ করিলেন বিবেচনা করিয়া চিন্তাকুলিতচিত্তে সেই বিজন পথে পরিভ্রমণ করিতে করিতে ভূতলে উপবেশন করিলেন। ঐ সময় পূর্ব্বে গান্ধারী তাঁহাকে যাহা কহিয়াছিলেন এবং তিনি উচ্ছিষ্ট পায়স পদতলে লিপ্ত না করাতে দুর্ব্বাসা যে সমুদায় বাক্য প্রয়োগ করিয়াছিলেন, সেই সমুদায় তাঁহার স্মৃতিপথে সমুদিত হইল। তখন তিনি নারদ, দুর্ব্বাসা ও কণ্বের বাক্য প্রতিপালন, তাঁহার স্বর্গগমনবিষয়ে দেবতাদিগের সন্দেহভঞ্জন ও ত্রিলোকপালন করিবার নিমিত্ত তাঁহাকে মর্ত্ত্যলোক পরিত্যাগ করিতে হইবে, বিবেচনা করিয়া ইন্দ্রিয়সংযম ও মহাযোগ অবলম্বন পূর্ব্বক ভূতলে শয়ন করিলেন। ঐ সময় জরানামক ব্যাধ মৃগবিনাশবাসনায় সেই স্থানে সমাগত হইয়া দূর হইতে যোগাসনে শয়ান কেশবকে অবলোকন পূর্ব্বক মৃগ জ্ঞান করিয়া, তাঁহার প্রতি শর নিক্ষেপ করিল।
ঐ শর নিক্ষিপ্ত হইবামাত্র উহা দ্বারা হৃষীকেশের পদতল বিদ্ধ হইল। তখন সেই ব্যাধ মৃগগ্রহণবাসনায় সত্বরে তথায় উপস্থিত হইয়া দেখিল, এক অনেকবাহুসম্পন্ন পীতাম্বরধারী যোগাসনে শয়ান পুরুষ তাহার শরে বিদ্ধ হইয়াছেন। লুব্ধক তাঁহাকে দর্শন করিবামাত্র আপনাকে অপরাধী বিবেচনা করিয়া, শঙ্কিতমনে তাঁহার চরণে নিপতিত হইল। তখন মহাত্মা মধুসূদন তাহাকে আশ্বাস প্রদান পূর্ব্বক অচিরাৎ আকাশমণ্ডল উদ্ভাসিত করিয়া স্বর্গে গমন করিলেন।
[[শ্রীকৃষ্ণ কি বলে ব্যাধকে আশ্বস্ত করেছিলেন তা ব্যাসদেব মহাভারতে লিখেন নাই, কিন্তু পরবর্তীতে ভাগবতে লেখেন— ভগবান্ শ্রীকৃষ্ণ তখন সেই ব্যাধকে সম্বোধনপূর্বক বলিলেন, “ওহে জরা! তোমার ভয় নাই ৷ এ সমস্ত আমারই ইচ্ছায় ঘটিয়াছে; ইহাতে তোমার কোন অপরাধ নাই ৷ অতএব পুণ্যবান ব্যক্তিগণ বহু সৎকর্মের ফলে যে স্বর্গলোকে গমন করিয়া থাকেন, তুমি আমার অনুগ্রহে সেই সুরপুরীতে গমন কর ৷” (শ্রীমদ্ভাগবত, ১১/৩০/৩৯) ]]
ঐ সময় ইন্দ্র, অশ্বিনীকুমারদ্বয় এবং রুদ্র, আদিত্য, বসু, বিশ্বদেব, মুনি, সিদ্ধ, গন্ধর্ব্ব ও অপ্সরোগণ তাঁহার প্রত্যুদ্গমনার্থ নির্গত হইলেন; তখন ভগবান্ নারায়ণ তাঁহাদের কর্ত্তৃক সৎকৃত হইয়া তাঁহাদের সহিত স্বীয় অপ্রমেয় স্থানে সমুপস্থিত হইলেন। দেবতা, মহর্ষি, সিদ্ধ, চারণ, গন্ধর্ব্ব, অপ্সরা ও সাধ্যগণ তাঁহার যথোচিত পূজা করিতে লাগিলেন; মুনিগণ ঋগ্বেদপাঠ ও গন্ধর্ব্বগণ সংগীত দ্বারা তাঁহার স্তব করিতে আরম্ভ করিলেন এবং দেবরাজ ইন্দ্র আহ্লাদিতচিত্তে তাঁহার অভিনন্দনে প্রবৃত্ত হইলেন।” (মৌসলপর্ব, অধ্যায়-৪)


শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে পূর্বেই খবর পাঠিয়েছিলেন ৷ অর্জুন সংবাদ পেয়ে সেখানে এসে কৃষ্ণের পিতা বসুদেবের সাথে সাক্ষাৎ করেন ৷ শোকাকুল বসুদেব অর্জুনের কাছে বহু বিলাপ করেন ৷ তিনি অর্জুনকে বলেন, “তুমি, দেবর্ষি নারদ ও অন্যান্য মহর্ষিগণ যাহারে সনাতন দেবদেব বলিয়া কীর্ত্তণ করিয়া থাক, তিনি এক্ষণে স্বচক্ষে জ্ঞাতিবধ প্রতক্ষ্য করিয়া উপেক্ষা করিলেন ৷ বোধহয়, গান্ধারী ও ঋষিগণের বাক্য অন্যথা করিতে তাঁহার বাসনা হয় নাই ৷ তোমার পৌত্র পরীক্ষিৎ অশ্বথামার ব্রহ্মাস্ত্র দ্বারা দগ্ধ হইলে, তিনিই তাহার জীবনদান করিয়াছিলেন, কিন্তু এক্ষণে স্বীয় পরিজনদিগকে রক্ষা করিতে তাঁহার বাসনা হইল না ৷” (মৌসলপর্ব, অধ্যায়-৬)

পরে ব্যাসদেব অর্জুনকে বলেছিলেনঃ “বৃষ্ণি ও অন্ধকবংশীয় মহারথগণ ব্রহ্মশাপে দগ্ধ হইয়াছে; অতএব তাহাদিগের নিমিত্ত তোমার শোক করা কর্তব্য নহে ৷ ঐ বীরগণের নিধন অবশ্যম্ভাবী বলিয়া মহাত্মা বাসুদেব উহা নিবারণে সমর্থ হইয়াও নিবারণে উপেক্ষা করিয়াছেন ৷ তিনি মনে করিলে মহর্ষিশাপখন্ডের কথা দূরে থাকুক, এই স্থাবর-জঙ্গমাত্মক বিশ্বসংসারকেও অন্যরুপ নির্মাণ করিতে পারেন ৷ সেই পতিতপাবন কেবল পৃথিবীর ভারাবতরণ করিবার নিমিত্তই বসুদেবের গৃহে উৎপন্ন হইয়াছিলেন ৷” (মৌসলপর্ব, অধ্যায়-৮)



                     (তথ্যসূত্রঃ মহাভারত, কালীপ্রসন্ন সিংহ অনুদিত)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

সাম্প্রতিক পোস্ট

পুরুষ—কৃষ্ণ ৷৷ প্রকৃতি—রাধা

 পুরুষ—কৃষ্ণ ৷৷ প্রকৃতি—রাধা ======================= যোগেনাত্মা সৃষ্টিবিধৌ দ্বিধারূপো বভূব সঃ ৷ পুমাংশ্চ দক্ষিণার্ধাঙ্গো বামাঙ্গঃ প্রকৃতিঃস্...

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ