মঙ্গলবার, ১১ আগস্ট, ২০২০

শুভ জন্মাষ্টমী : ভগবানের জন্ম কিভাবে সম্ভব?




♥ শুভ জন্মাষ্টমীর শুভেচ্ছা ♥
আজ ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথি, এই দিনে জন্ম হয়েছিল ভগবান শ্রীকৃষ্ণের, তাই একে জন্মাষ্টমী বলে ৷ জন্মাষ্টমী = জন্ম + অষ্ঠমী ৷ শ্রীকৃষ্ণ, যিনি বিশ্বজগতের পিতা, তিনি কিনা বসুদেব ও দেবকীর পুত্ররূপে জন্ম গ্রহণ করলেন? এ বড় অদ্ভূত সন্দেশ নয় কি? কি প্রয়োজন ছিল স্বয়ং সৃষ্টিকর্তার পৃথিবীতে জন্ম নেবার?

বাস্তবিকপক্ষে, ভগবানের নিজের তো কোন প্রয়োজন নাই পৃথিবীতে জন্ম নেবার, তবুও যে তিনি জন্ম নিলেন তা কেবল আমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে, মানবজাতির হিতকল্যাণ করার জন্য ৷ আমরা অধম, ধর্ম-কর্ম জানিনা, কে শেখাবে আমাদের? যদি বলো যে, তিনি কোন প্রবর্তক মহাপুরুষ পাঠিয়ে দিতে পারতেন, আমাদের শেখাবার জন্য ৷ কিন্তু বলো দেখি সেই প্রবর্তক মহাপুরুষ কার কাছ থেকে শিখে আমাদের শেখাবেন? তাই ভগবান হচ্ছেন আদিগুরু, তাই তিনি স্বয়ং মানুষরূপে অভিনয় করে মানুষকে শেখান ৷ “আপনি আচারিয়া ধর্ম লোকেরে শেখায়” ৷ ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নিজেই বলেছেন একথা -

“শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি যাহা যাহা আচরণ করেন, অপর সাধারণেও তাহাই করে । তিনি যাহা প্রামাণ্য বলিয়া বা কর্তব্য বলিয়া গ্রহণ করেন, সাধারণ লোকে তাহারই অনুবর্তন করে । হে পার্থ, ত্রিলোক মধ্যে আমার করণীয় কিছু নাই, অপ্রাপ্ত বা প্রাপ্তব্য কিছু নাই, তথাপি আমি কর্মানুষ্ঠানেই ব্যাপৃত আছি । হে পার্থ, যদি অনলস হইয়া কর্মানুষ্ঠান না করি, তবে মানবগণ সর্বপ্রকারে আমারই পথের অনুবর্তী হইবে । (কেহই কর্ম করিবে না) ।” (পবিত্র গীতা ৩/২১—২৩)

তিনি নিজের আবির্ভাব সম্পর্কে আরো বলেছেন -

অজোহপি সন্নব্যয়াত্মা ভূতানামীশ্বরোহপি সন্ ।
প্রকৃতিং স্যামধিষ্ঠায় সম্ভবাম্যাত্মমায়য়া ।।
— “আমি জন্মরহিত, অবিনশ্বর এবং সর্বভূতের ঈশ্বর হইয়াও স্বীয় প্রকৃতিতে অনুষ্ঠান করিয়া আত্মমায়ায় আবির্ভূত হই ।” (ঐ, ৪/৬)

ভগবান জন্মরহিত, অর্থাৎ তার জন্মের বাধ্যবাধকতা নাই, সাধারণ জীব পূর্বজন্মের সঞ্চিত কর্মফল ভোগের জন্য জন্ম নিতে বাধ্য, কিন্তু ভগবান জন্ম নেন ‘আত্মমায়ায়’ অর্থাৎ নিজ ইচ্ছায় ৷ কেন? উত্তর—

যদা যদাহি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত ।
অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্ ।।
— “হে ভারত ! যখনই যখনই ধর্মের গ্লানি এবং অধর্মের অভ্যুত্থান হয়, আমি সেই সেই সময়ে নিজেকে সৃষ্টি করি (দেহ ধারণপূর্বক অবতীর্ণ হই) ।” (ঐ, ৪/৭)

পরিত্রাণায় সাধূনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্ ।
ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে ।।
— “সাধুগণের পরিত্রাণ, দুষ্টদিগের বিনাশ এবং ধর্মসংস্থাপনের জন্য আমি যুগে যুগে অবতীর্ণ হই ।” (ঐ, ৪/৮)

সাধারণ লোকেরা জন্ম নিজ ইচ্ছা অনুসারে হয়না, হয় কর্মানুসারে, কারণ তারা কর্ম করে কর্মবন্ধনে আবদ্ধ হয় ৷ কিন্তু ভগবান জন্ম-কর্ম কেবল লোকশিক্ষার্থ, তিনি জন্ম-কর্ম করেও তাতে আবদ্ধ হননা ৷ তাই ভগবানের জন্ম কর্ম দিব্য অর্থাৎ অলৌকিক ৷

জন্ম কর্ম চ মে দিব্যমেবং যো বেত্তি তত্ত্বতঃ ।
ত্যক্ত্বা দেহং পুনর্জন্ম নৈতি মামেতি সোহর্জুন ।।
—“হে অর্জুন, আমার এই দিব্য জন্ম ও কর্ম যিনি তত্ত্বতঃ জানেন, তিনি দেহত্যাগ করিয়া পুনর্বার আর জন্মপ্রাপ্ত হন না - তিনি আমাকেই প্রাপ্ত হন ।” (ঐ, ৪/৯)

ভগবানের পক্ষে এই জগৎ এক রঙ্গমঞ্চ ৷ অভিনেতা যেমন নাট্যমঞ্চে বিভিন্ন পোশাক-পরিচ্ছেদ ধারণ করে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করে, ভগবানও তদ্রুপ বিভিন্ন নাম-রূপ ধারণ করে আবির্ভূত হয়ে অভিনয় (লীলা) করেন ৷ তার জন্ম-কর্ম লোকশিক্ষার্থ ও স্বীয় ভক্তজনকে আনন্দ প্রদানার্থ অভিনয় মাত্র ৷

শ্রীশুকদেব গোস্বামী তাই বলেছেন-
“হে রাজন্! অভিনেতা যেরুপ স্বরুপতঃ অবিকৃত থাকিয়াই রঙ্গমঞ্চে দর্শকগণের সমক্ষে বিবিধ জন্মমরণাদি লীলা অভিনয় করে, পরমাত্মা শ্রীকৃষ্ণের যাদবাদিকুলে আবির্ভাবতিরোভাবচেষ্টাও সেরুপ মায়াভিনয়মাত্র জানিবে ৷ বস্তুতঃ সেই পরমপুরুষ স্বয়ংই এই জগৎ সৃষ্টি করেন, এতে অবতরণ করেন ও বিহার করেন এবং লীলা শেষে নিজ স্বরুপে স্থিত হন ৷”
[ #শ্রীমদ্ভাগবত মহাপুরাণ ১১৷৩১৷১১]

প্রপঞ্চং নিষ্প্রপঞ্চোহ’পি বিড়ম্বয়সি ভূতলে ৷
প্রপন্নজনতানন্দসন্দোহং প্রথিতং বিভো ৷৷
“হে বিভো শ্রীকৃষ্ণ, তুমি প্রপঞ্চাতীত হয়েও ভক্তজনগণের আনন্দসমূহ বিস্তার করার জন্য ভূতলে প্রপঞ্চস্থ পুত্রাদিভাবের অনুকরণ করছো ৷” [#শ্রীমদ্ভাগবত মহাপুরাণ ১০৷১৪৷৩৭]

মমস্তস্মৈ ভগবতে কৃষ্ণায়ামলকীর্ত্তয়ে ৷
যো ধত্তে সর্ব্বভূতানামভবায়োশতীঃ কলাঃ ৷৷
“যে সর্ব্বেশ্বর ভগবান্ নিখিল জীবগণের সংসার-দুঃখের নিবারণার্থ কমনীয় বিগ্রহ-সমূহ ধারণে আবির্ভূত হন, সেই পবিত্রকীর্ত্তি ভগবান্ শ্রীকৃষ্ণকে আমি প্রণাম করি ৷” [শ্রীমদ্ভাগবত ১০৷৮৭৷৪০]


//ওঁ শ্রীকৃষ্ণার্পণমস্তু //

1 টি মন্তব্য:

সাম্প্রতিক পোস্ট

পুরুষ—কৃষ্ণ ৷৷ প্রকৃতি—রাধা

 পুরুষ—কৃষ্ণ ৷৷ প্রকৃতি—রাধা ======================= যোগেনাত্মা সৃষ্টিবিধৌ দ্বিধারূপো বভূব সঃ ৷ পুমাংশ্চ দক্ষিণার্ধাঙ্গো বামাঙ্গঃ প্রকৃতিঃস্...

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ