শ্রীমন্ মহাপ্রভু গৌরাঙ্গসুন্দর বলেছেন—
“গৌণ মুখ্য বৃত্তি বা অন্বয় ব্যতিরেকে ৷
বেদের প্রতিজ্ঞা কেবল কহয় কৃষ্ণকে ৷৷”
এই কথা পড়ে প্রথমে আমরা আশ্চর্যান্বিত হই ৷ বেদে কৃষ্ণকথা কই?
অসতাং নিগ্রহার্থায় ধর্ম্মসংরক্ষণায় চ ৷
অবতীর্ণো মনুষ্যাণামজায়ত যদুক্ষয়ে ৷
স এষ ভগবান্ বিষ্ণুঃ কৃষ্ণতি পরিকীর্ত্ত্যতে ৷৷
“সেই ভগবান বিষ্ণুই দুর্জ্জনের নিগ্রহ এবং ধর্ম্মরক্ষার জন্য মনুষ্যমধ্যে অবতীর্ণ হইয়া যদুকুলে জন্মিয়াছিলেন; তাঁহাকেই ‘কৃষ্ণ’ বলা হয় ৷” (বনপর্ব, ২২৬/৬৮)
কিন্তু যখন বুঝলাম কৃষ্ণ আর বিষ্ণু একই, তখন আশ্চর্য হওয়ার কিছুই নেই ৷ কারণ পবিত্র বেদে ভগবান বিষ্ণুর কথা অনেক আছে ৷ সুতরাং বেদে কৃষ্ণকথা আছে ৷ তবে মহাপ্রভু বলেছেন— কেবল কৃষ্ণকথা বলাই বেদের প্রতিজ্ঞা ৷ এই কথা কি করে ঠিক হয় তা চিন্তার বিষয় ৷ কেননা বেদে অগ্নি, ইন্দ্র, বায়ু, বরুণ প্রমুখ দেবতাদের কথা আছে ৷ তাহলে বেদ শুধু কৃষ্ণকথাই বলেছে তা কিরুপে সত্য হয়?
উত্তর এই যে, বেদে যত দেবতাদের কথাই থাকুক, তা মূলত একজনেরই নাম ৷ বেদ কেবল এতজনের কথাই বহু প্রকারে, বহু নামে বলেছে ৷ প্রমান দেখুন, বেদ বলেছে—
১) “একং সদ্বিপ্রা বহুধা বদন্ত্যগ্নিং যমং মাতরিশ্বানমাহুঃ”
—“তিনি এক ও সৎ (নিত্য), তাঁহাকেই জ্ঞানীগণ বিভিন্ন নাম দিয়া থাকেন— তাঁহাকেই অগ্নি, যম, মাতশ্বিরা প্রভৃতি বলা হয় ৷” (ঋগ্বেদ ১/১৬৪/৪৬)
২) “যিনি আমাদিগের পিতা ও জন্মদাতা, যিনি বিধাতা, যিনি বিশ্বভুবনের সকল স্থান অবগত আছেন, যিনি অনেক দেবগণের নাম ধারণ করেন, কিন্তু এক ও অদ্বিতীয়, ভুবনের লোকে তাঁহাকে জানিতে ইচ্ছা করে ৷” (ঋগ্বেদ ১০/৮২/৩)
অর্জুনও বলেছেন, “বায়ু, যম, অগ্নি, বরুণ, তুমিই ৷ পিতামহ ব্রহ্মাও তুমি এবং ব্রহ্মার জনকও তুমি ৷ তোমাকে সহস্র বার নমস্কার করি, আবারও পুণঃ পুণঃ তোমাকে নমস্কার করি ৷” (গীতা ১১/৩৯)
গীতাতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ংই বলেছেন, “আমিই এই জগতের পিতা, মাতা, বিধাতা, পিতামহ”(৯/১৭) এবং—
“বেদৈশ্চ সর্বৈরহমেব বেদ্যো বেদান্তকৃদ্ বেদবিদেব চাহম্”
অর্থাৎ, আমিই সমস্ত বেদের জ্ঞাতব্য এবং আমিই বেদান্তকর্তা ও বেদবিৎ (১৫/১৫)৷
এছাড়া ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা বেদে সরাসরি থাকতে পারে কিনা? অনেকে আপত্তি করেন যে শ্রীকৃষ্ণ দ্বাপর যুগের লোক, অথচ বেদ সৃষ্টির প্রারম্ভে উৎপন্ন, তাহলে বেদে কৃষ্ণকথা কিভাবে থাকতে পারে ৷ এই আপত্তিকারীদের মনে ধারণা যে বেদ যেহেতু সৃষ্টির প্রারম্ভে উৎপন্ন, তাই বেদে কেবল ঐ সময়ের কথা থাকা সম্ভব ৷ যদি তাই-ই হয়, তবে বেদ নিত্য হয় কি করে? বেদ নিত্য তথা সর্বকালের, তাই বেদে অতীত-বর্তমান-ভবিষৎ সকল কালের কথাই থাকা সম্ভব, নতুবা বেদ নির্দিষ্ট সময়কালের মধ্যে পরিছন্ন হয়ে যায় ৷ তাছাড়া গৌড়ীয় আচার্যগণ কৃষ্ণলীলার নিত্যতা প্রতিপাদন করেছেন, অতএব নিত্য বেদে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নিত্যলীলা বর্ণিত থাকবে তা অসম্ভব হয় কি করে?
অতি দুঃখের বিষয় এই যে, শ্রীকৃষ্ণই বেদের একমাত্র জ্ঞাতব্য বিষয় হওয়া সত্ত্বেও প্রচলিত বেদভাষ্যগুলোতে শ্রীকৃষ্ণের কথা উল্লেখ করা হয়নি ৷ তাই আপনাদের সামনে তুলে ধরছি এমন একটি গ্রন্থ যেখানে বেদমন্ত্রে কৃষ্ণলীলা প্রতিপাদন করা হয়েছে ৷ গ্রন্থটি—
শ্রীমন্ নীলকন্ঠ সূরি কৃত ‘শ্রীমন্ত্র-ভাগবতম্’