মীরাবাঈ লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
মীরাবাঈ লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

শুক্রবার, ৩ নভেম্বর, ২০১৭

কৃষ্ণপ্রিয়া মীরা : পর্ব-৩


=======================

ঊদাবাঈ এর প‌রিবর্তন

=======================

বিক্রম‌জিৎ রাণা ছি‌লেন ক‌ঠোর প্রকৃ‌তির ও স্থূল অনুভূ‌তি সম্পন্ন মানুষ। তি‌নি স্থির কর‌লেন অবাধ্য মীরার প্র‌তি কড়া নজর রাখা প্র‌য়োজন, এবং সে কা‌জে অপর কাউ‌কে বিশ্বাস‌যোগ্য ম‌নে না হওয়ায় আপন ভ‌গিনী ঊদাবাঈ‌কে নিযুক্ত কর‌লেন । তাছাড়াও আ‌রো তিন নীরা প্রহরী সর্বক্ষণ পাহারা দেওয়ার জন্য মোতা‌য়েন করা হ‌লো । ঊদাবাঈ মীরার মন প‌রিবর্তনের জন্য সর্ব‌তোভা‌বে স‌চেষ্ট হ‌লেন । ঊদাবাঈ- এর স‌ঙ্গে মীরার কথোপকথ‌নের এক চমকপ্রদ বিবরণ লোকমু‌খে প্র‌চলিত আ‌ছে, যা‌তে মীরার অপা‌র্থিব দৃ‌ষ্টিভ‌ঙ্গি ও নির্ভীক চ‌রি‌ত্রের কিছু প‌রিচয় পাওয়া যায় ।

ঊদা => মীরা তু‌মি সাধুসঙ্গ ত্যাগ কর । রাজ্যময় তোমার না‌মে হাজা‌রো নিন্দা।
মীরা => তা‌তে আমার কি ? ও‌দের নিন্দা রটা‌তে দাও । আ‌মি সাধু‌দের ভক্ত ।
ঊদা => তু‌মি মু‌ক্তোর মালা গলায় দাও না, বহুমূল্য অলঙ্কার সে সবও ব্যবহার কর না, কেন ?
মীরা => সে সব ভাই, আ‌মি বিদায় ক‌রে‌ছি । সৎ চিন্তা ও স‌ন্তোষই আমার ভূষণ ।
ঊদা => অন্য সবখা‌নে কত রঙচ‌ঙে শোভাযাত্রা, নারী-প‌ুরু‌ষের কত জমাট মজ‌লিশ, আর তোমার এখা‌নে যত সাধু-ভক্তের মেলা ।
মীরা => দেখ দেখ, বা‌ড়ির ছা‌দে উ‌ঠে, সাধুর শোভা! কি চমৎকার না দেখা‌চ্ছে!
ঊদা => চি‌তো‌রের সকল মানুষ আজ তোমার জন্য ল‌জ্জিত । মহারাণার মাথা লজ্জায় হেঁট!
মীরা => চি‌তোর আজ মুক্ত হ‌য়ে‌ছে, আর রাণার পথও মুক্ত ।
ঊদা => তোমার মা-বাবা তোমার আচর‌ণে ল‌জ্জিত, তোমার জন্মস্থানও কল‌ঙ্কিত ।
মীরা => ধন্য আমার মা-বাবা । ধন্য আমার জন্মভূ‌মি ।
ঊদা => রাণা তোমার উপর ক্ষুব্ধ । তোমার জন্য তি‌নি রত্নখ‌চিত পা‌ত্রে বিষ তৈরি রে‌খে‌ছেন ।
মীরা => বেশ তো বোন, আ‌মি তা প্রভুর চরণামৃত ব‌লে পান করব ।
ঊদা => যে সে বিষ নয় তা । অ‌তি ভয়ানক, তা দেখা মাত্রই তুুমি মারা পড়‌বে ।
মীরা => এ জগ‌তে আমার তো কেউ নেই । মা বসুন্ধরা কোল পে‌তে আমায় গ্রহণ কর‌বেন ।
ঊদা => রাণাজী জান‌তে চান, স‌তি ক‌রে বল তো তোম‌ার পথ কি?
মীরা => ক্ষু‌ধের ধার আম‌ার পথ । মহারাণ‌ার সাধ্য কি সেখা‌নে পৌঁছান?
ঊদা => রাণার অবাধ্য হ‌য়ো না, মীর‌া । তাঁর কথা শোন । তিনি ক্রুদ্ধ হ‌লে জগ‌তে আর কোথাও তোম‌ার স্থান নেই জে‌নো ।
মীরা => গি‌রিধারীলাল আমার আশ্রয়, ঊদা । কায়-ম‌নো-বাক্যে আমি তাঁরই শরণাগত ।

এভাবে ঊদাবাঈয়ের সকল চেষ্টা মীন‌াবাঈ‌য়ের ম‌নের প‌রিবর্তন ঘটা‌তে ব্যর্থ হ‌লো । মীরা তাঁর নিজের জগ‌তে বিচরণ কর‌তে থাক‌লেন, ইহজগতের ভয়, প্র‌লোভন কোন কিছুই তাঁর ম‌নে প্রভ‌াব বিস্তার কর‌তে সক্ষম হলো না ।
অবশ্য পরিবর্তন ঘ‌টে‌ছিল ত‌বে তা মীরার নয় ঊদাবাঈ‌য়ের । স্পর্শম‌ণির ছোঁয়ায় লোহা সোনায় রূপা‌ন্ত‌রিত হ‌লো । ঊদার উপর বিক্রম‌জি‌তের ভরসা ছিল য‌থেষ্ট, কারণ তাঁর ধারণ‌া সে তাঁর একান্ত অনুগত ভক্ত । কিন্তু সাধুসঙ্গ অ‌তি বিস্ফোরক বস্তু । এক‌দিন জগৎ ভু‌লে, একমাত্র তাঁর দ‌য়ি‌তের চিন্ত‌ায় মগ্ন হ‌য়ে, ভাবে বি‌ভোর মীরা গাই‌ছি‌লেনঃ

“ত্যা‌জে‌ছি সকল লজ্জা, স‌খি, ত্যা‌জে‌ছি কুল-মান
য‌বে পে‌য়ে‌ছি আমার শ্যাম ।
ভু‌লে‌ছি সক‌ল সুখ
আমার টুটু‌ছে বন্ধন ভয় ।
আহা! কি বা শোভা তাঁর শিরে শিখী-পাখা
ললাটে তিলক‌রেখা,
ত্রিভুবনে কে বা পা‌রে ভু‌লিতে
ঐ ভুবন মোহন সাজ ?
চিকন যুগল গ‌ণ্ডে তাঁর কর্ণকুণ্ডল ছায়া
সুনীল সায়‌রে সঞ্চরে যথা
ক্রীড়াচঞ্চল মীন,
ব‌ঙ্কিম ভ্রূ, চপল নয়ন–
লজ্জা পায় খঞ্জনার রূপ অ‌ভিমান ।
সুচারু তাঁর তীক্ষ্ম নাসা, নয়ন ভু‌লা‌নো বেশ
রক্ত‌গোলাপ ও‌ষ্ঠে শো‌ভে মধুর হাস্য রেস ।
সুষ্ঠু শোভন দ‌ন্তে বিছু‌রে
শুভ্র আ‌লোক রা‌শি,
বিজলী চমকে আভর‌ণে তাঁর
আ‌লোর পরশ লা‌গি ।
তনু-মন-প্রাণ মীরা ক‌রিয়া‌ছে দান
ঐ অপরূপ রূপ হে‌রি! ”

মীরার হৃদয় উৎসা‌রিত সেই গা‌নের মাধুর্য ঊদাবাঈ‌য়ের প্রা‌ণে ঘটাতে থা‌কে প্রবল বি‌ক্রিয়া, তার অন্তর্জগ‌তে ঘ‌টে পরিবর্তন, মীরার পদত‌লে নতজানু হ‌য়ে ভিক্ষা ক‌রে তাঁর শিষ্যত্ব । ঊদার পক্ষে অতঃপর শুরু হ‌লো ভিন্ন প্রকার রা‌ত্রি জাগরণ । তার যে পরিবর্তন ঘ‌টে‌ছিল তা ছিল তাৎক্ষণিক । এখন সে গি‌রিধ‌রের সাক্ষাৎ দর্শনলা‌ভের জন্য প্রবল আকাঙ্ক্ষা বোধ কর‌তে থাকল এবং যা‌তে তি‌নি দর্শন দেন তার জন্য মীরার নিকট কাতর প্রার্থনা করল ।
মীরা স্বভাবতই ছি‌লেন উদার প্রকৃ‌তির । ঊদার ব্যাকুলতা তাঁ‌কে গভীরভাবে স্পর্শ করল এবং তিনি ঊদাবাঈ‌য়ের আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করার জন্য গি‌রিধ‌রের নিকট আকুল প্রার্থনা জানা‌লেন । তখন মধ্যরা‌ত্রি । ঊদা ও তার অপর তিন স‌ঙ্গিনী- মিথুলা, চম্পা, চা‌মেলী ম‌ন্দি‌রে বসে আ‌সে । মীরা ত‌াঁর মধুর কিন্নরী ক‌ন্ঠে এ‌কের পর এক ভজন গে‌য়ে চল‌ছেন । হঠাৎ সক‌লের বিস্মিত দৃ‌ষ্টির সম্মু‌খে স্বয়ং গি‌রিধারীলা‌লের দিব্য আ‌বির্ভ‌াব । তি‌নি জিজ্ঞাসা কর‌লেন - “মীরা, আজ রা‌তে তু‌মি কেন এত যন্ত্রণা কাতর?”

সাধুস‌ঙ্গে এমন ক‌রেই অসম্ভবও সম্ভব হয় ৷ এর ফ‌লে কেবলমাত্র ঊদাই নয়, অপর তিনজন যারা আ‌দৌ বি‌শেষ আগ্রহী ছিল না, তা‌দেরও ঈশ্বন দর্শন হ‌লো ।



বৃহস্পতিবার, ২৬ অক্টোবর, ২০১৭

কৃষ্ণপ্রিয়া মীরা : পর্ব-২


=====================

আহ্বান ও মীরার সাড়া

=====================

১৫২৩ খ্রীষ্টা‌ব্দে মীরার বয়স যখন মাত্র স‌তে‌রো, তাঁর স্বামী ভোজরাজ দেহত্যাগ কর‌লেন । কোন কোন জীব‌নী‌তে ভোজরা‌জকে চি‌ত্রিত করা হ‌য়ে‌ছে একজন ঈর্ষাপরায়ণ স্বামীরূপে ৷ যি‌নি মীরার প্রবল ঈশ্বরানুর‌ক্তি— যা তাঁ‌কে মধুর দাম্পত্য সুখ হ‌তে ব‌ঞ্চিত ক‌রে‌ছে, তার প্র‌তি বি‌দ্বেষযুক্ত হ‌য়ে স্ত্রী মীরার প্র‌তি অত্যন্ত ক‌ঠোর ব্যবহার কর‌তেন । আবার কেউ কেউ এরূপ ধ‌ারণার বি‌রো‌ধিতা করে‌ছেন, তাঁ‌দের ম‌তে ভোজরাজ একজন বিরহী স্বামী, যি‌নি স্ত্রী‌কে অত্যন্ত ভালবাস‌লেও তাঁর হৃদয় লা‌ভে অসমর্থ হ‌য়ে‌ছি‌লেন, কারণ মীরার মন সম্পূর্ণতই ভগবৎ প্রে‌মে বাঁধা প‌ড়েছিল ।
যাই‌হোক, স্বামীর মৃত্যুর পর মীরার জীব‌নের এক নতুন অধ্যায় শুরু হলো । সে অধ্যায়‌টি তাঁর জীব‌নে মহা পরীক্ষার এবং সেই স‌ঙ্গে তা সাফ‌ল্যেরও ব‌টে । ক‌থিত আ‌ছে, এইসময় তি‌নি রইদাস নামক এক বৈষ্ণব সাধুর নিকট মন্ত্রদীক্ষা গ্রহণ ক‌রেন । তাঁর বৈধব্য অ‌তি স্বাভাবিকভা‌বেই তাঁর আধ্যা‌ত্মিক সাধনা তীব্রতর ক‌রে‌ছিল । এখন গুরুর নিকট নির্দিষ্ট পথ‌নি‌র্দেশ লাভ ক‌রে তাঁর ব্যাকুলতা, তন্ময়তা, সাধুসঙ্গ লা‌ভের জন্য তীব্র স্পৃহা, গতানুগ‌তিক সাংসা‌রিক জীব‌নের প্র‌তি প্রবল বিতৃষ্ণা প্রভৃ‌তি অনন্তগু‌ণে বৃ‌দ্ধি পেল এবং সে সকল অহরহ তাঁকে উত্ত্যক্ত কর‌তে থাকল ।
ইতিম‌ধ্যে শ্বশুর সংগ্রাম সিং‌হের মৃত্যু হ‌য়ে‌ছে এবং ভোজরা‌জের ভ্রাতা কুমার বিক্রম‌জিৎ রাণা চি‌তো‌রের সিংহাস‌নে আ‌রোহণ ক‌রে‌ছেন । তি‌নি মীরার প্র‌তি ক‌ঠোর নিয়ম জা‌রি কর‌তে বিন্দুমাত্র বিলম্ব কর‌লেন না । কিন্তু মীরার সাধনভজন একান্তভা‌বেই তাঁর নিজস্ব ধারায় অগ্রসর হ‌তে থাকল ।
তিনি গি‌রিধারী গোপা‌লের সম্মু‌খে নৃত্য কর‌তেন, আপ্লুত হৃদ‌য়ে ভজন নি‌বেদন করেন । স‌াধুসঙ্গ লা‌ভের সু‌যোগ তো কিছুমাত্রও হারান না ।
সাধুসঙ্গ লা‌ভের তৃষ্ণা তাঁর এতই তীব্র ছিল যে, রাজপরিবা‌রের প্রথাগত বি‌ধি‌নিয়ম সকল শি‌থিল ক‌রেও অধ্যাত্ম প্রেরণালা‌ভের জন্য সাধুভ‌ক্তের সঙ্গ কর‌তেন । অশু‌দ্ধচিত্ত মানুষজ‌নের স্বভাবতই মীরার এই সাধুপ্রী‌তির অর্থ বোধগম্য হয়‌নি ।
মহারাজা বিক্রম‌জিৎ রাণা অতঃপর আ‌দেশ জা‌রি কর‌লেন, মীরা‌কে তার ঐ অ‌শোভন নৃত্য-গীত বন্ধ কর‌তে হবে এবং আ‌রো আপ‌ত্তিকর, তার ঐ সাধু‌দের স‌ঙ্গে মেলামেশা ত্যাগ কর‌তে হবে । তি‌নি না একজন নারী? তি‌নি না বিধবা? ত‌বে কেন তাঁর এই পুরুষ মানুষ‌দের সঙ্গলাভে ব্যাকুলতা? বিক্রম‌জিৎ সেই অপ‌াপা‌বিদ্ধা প‌বিত্রা নারীর বিরুদ্ধে কলঙ্ক রটনা কর‌তেও কিছুমাত্র বিচ‌লিত হ‌লেন না ।
রাজ-অন্তঃপু‌রে মীরা যখন এরূ‌পে সাধনভজ‌নে বাধাপ্রাপ্ত হ‌লেন, তি‌নি নিকটবর্তী এক দেবাল‌য়ে আশ্রয় গ্রহণ ক‌রে সেখা‌নেই তাঁর অ‌ভিরু‌চি অনুযায়ী সাধ‌নে মগ্ন হ‌লেন । তাঁর অভূতপূর্ণ দিব্য অনুরাগ ও প্রেম শীঘ্রই মানু‌ষের দৃ‌ষ্টি আকর্ষণ ক‌রল এবং ক্রমশই নিকট ও দূর-দূরান্তর হ‌তে দ‌লে দ‌লে ভক্তরা তাঁর নিকট আধ্যা‌ত্মিক অনু‌প্রেরণা লা‌ভের আশায় এ‌সে জমা‌য়েত হ‌তে থাকল । ফ‌লে মহারাণা ও পরিবারের অপরাপর লোকজ‌নের ক্রোধ উত্তরোত্তর বৃ‌দ্ধি পে‌তে থাকল । মীরা‌কে অতঃপর আক্ষ‌রিত অ‌র্থেই প্রাসা‌দের অভ্যন্তরে বন্দী করা হলো এবং তাঁর উপর এ‌কের পর এক নানাপ্রকার অমা‌নবিক নির্যাতন চল‌তে থাকল ।
মীরা নিছক এক ঈশ্বর‌প্রে‌মিক মাত্রই ছি‌লেন না, তি‌নি ক‌বিও ব‌টে । তাঁর কাব্য, যা তি‌নি ভজনাকার তাঁর গি‌রিধারীলা‌লের নিকট নি‌বেদন করতেন তা‌তে তাঁর প্র‌তি হওয়া নির্যাতন সম্প‌র্কে কিঞ্চিৎ আভাস মেলে । সে নির্যাতন কি অমানুষিক ছিল তা জেনে বিস্মিত হ‌তে হয়, কিন্তু মীরা কত সহ‌জে সে সকল সহ্য ক‌রে‌ছি‌লেন । এক‌টি ভজ‌নে মীরা গে‌য়ে‌ছেন তাঁর অভিজ্ঞতার কথা—

“মীরা সুখী তার প্রি‌য়ের পূজায় ।
ঝু‌ড়ি ভ‌রে সর্প আ‌সে মীরার তরে -
র‌াণার উপহ‌ার ।
ঝু‌ড়ি খু‌লে দে‌খে মীরা প্রভু স্বয়ং ।
রাণা পাঠান পেয়াল‌া ভরা বিষ ,
মীরা পান ক‌রে তা আকন্ঠ । 
বিষ হয় অমৃত , 
তাঁর (শ্রীকৃ‌ষ্ণের) ক‌ারসা‌জি‌তে ।
আ‌সে কন্টকশয্যা রাণার কাছ হতে ,
মীরা দে‌খে সে যে ফুল শয্যা ।
সকল বিপদ তুচ্ছ হয় 
গিরিধারীর সর্তক রক্ষ‌ণে । 
প্রেম মদিরায় মা‌তোয়ারা মীরা 
হাসে, নাচে, গায় প্রভুর নাম, 
উৎসর্গীকৃত সে যে 
  দ‌য়ি‌তের চর‌ণে ।”

ভক্তজীব‌ন অবলম্বন ক‌রে ভগবানের কৃপা ব‌হে শতধারে সহস্র বি‌চিত্র প‌থে । গান্ধী হত্যার সংবাদ শুনে বার্ণার্ড শ' আ‌র্তি প্রকাশ ক‌রে‌ছি‌লেন, “এই দু‌নিয়ায় ভাল মানুষ হবার এই তো ফল ৷” শ্রীরামচ‌ন্দ্রের ভক্ত ছি‌লেন গান্ধীজী । মাত্র কিছু‌দিন আ‌গেই এক প্রার্থন‌া সভায় বোমা বি‌স্ফো‌রণ হওয়া স‌ত্ত্বেও তিনি অক্ষত আ‌ছেন জে‌নে লো‌কে ব‌লে‌ছিল ‘রা‌খে হ‌রি মারে কে?’ কিন্তু তার অল্প‌দিন প‌রেই সেই শ্রীহরি তাঁ‌কে খুনীর বু‌লেট হ‌তে বাঁচা‌তে এ‌গি‌য়ে এ‌লেন না ।
পুরা‌ণে ক‌থিত বিষ্ণুর বালকভক্ত প্রহ্লাদকে হা‌তির পা‌য়ের নি‌চে ফে‌লে, পাহা‌ড়ের চূড়া হ‌তে ফে‌লে অথবা বিষ প্র‌য়োগা‌দি বি‌বিধ উপা‌য়েও মারা সম্ভব হয়‌নি । আবার সেই ঈশ্বর যীশু‌কে ক্রুশ‌বিদ্ধ বেশ নি‌র্বি‌ঘ্নেই ঘ‌টে‌ছিল । কিন্তু মীরার ক্ষে‌ত্রে গি‌রিধারীলাল তাঁ‌কে সর্ব‌তোভা‌বে রক্ষা ক‌রে যা‌চ্ছি‌লেন ।
ভগবা‌নের এক‌নিষ্ট ভক্ত‌দের জীব‌নের বি‌ভিন্ন ঘটনা আ‌লোচনা করে আমরা কখনো বা হতবু‌দ্ধি হ‌য়ে প‌ড়ি ।
আমা‌দের পক্ষে ঈশ্বর কৃপার প্রকৃত অর্থ সম্যক উপল‌ব্ধির প্রধান বাধা এই যে, আমরা স্থূলদৃ‌ষ্টি‌তে ভ‌ক্তি‌কে একপ্রক‌ার বি‌নি‌য়োগ ব‌লে বি‌বেচনা ক‌রি । আ‌মি ভগবা‌নকে ভ‌ক্তি ক‌রি; সুতরাং তাঁ‌কে হ‌তে হ‌বে একাধা‌রে আমার ব্য‌ক্তিগত পু‌লিশ, চি‌কিৎসক, উ‌কিল ইত্যা‌দি সব‌কিছু । অর্থাৎ তাঁ‌কে হতে হবে আমার আপৎকালীন লাইফ‌বোট । ভ‌ক্তির নগদ বিদায় হিসা‌বে পাওয়া চাই স্ব‌র্গের শিল‌মোহরা‌ঙ্কিত সুরক্ষা পত্র । ধর্ম‌ক্ষে‌ত্রে এরূপ ম‌নোভাব হ‌লো ব্যবসাদা‌রি, বা প্রশয় লাভের আগাম অঙ্গীকারপত্র গ্রহণ ক‌রে তার বি‌নিম‌য়ে বি‌বিধ অ‌বৈধ উপা‌য়ে ফল‌াও উপায়ে ফলাও কারবার করা !
গরল যখন অমৃত রূপান্ত‌রিত হয় তখন সত্যতা বজায় থা‌কে, আবার যখন বিষ স‌ক্রিয় হয় তখনও । যারা সৎকর্ম কর‌তে ব্রতী হ‌য়ে তার শুভাশুভ কর্মফল শান্ত‌চিত্তে গ্রহণ কর‌তে প্রস্তুত থাকে, ভগবানের কৃপা তাদের উপরই ব‌র্ষিত হয় । মীরা বিষ অমৃ‌তে প‌রিণত হ‌বেই এমন‌টি আশা ক‌রে তা গ্রহণ ক‌রে‌ছি‌লেন এমন নয়, তি‌নি তা গ্রহণ ক‌রে‌ছি‌লেন পরম প্রেমাষ্পদের প্রের‌তি প্রসাদ জ্ঞানে । কৃপার সত্যতা প্রমা‌ণিত হয় ভগবান প্রদত্ত সেই শ‌ক্তির আ‌বির্ভাব চাক্ষুষ ক‌রে, যার ব‌লে ভক্ত যে কোন ফ‌লের জন্য সদা প্রস্তুত থা‌কে, নিঃশঙ্ক থা‌কে ।
মহা‌যোগী পত্তহারী বাবা‌কে যখন সর্প দংশন ক‌রে‌ছিল, তি‌নি ব‌লে‌ছি‌লেন, “প্রভুর নিকট হ‌তে দূত প্রে‌রিত হ‌য়ে‌ছে । " ভাল-মন্দ, আনন্দ-বেদনা, আনুকূল্য-প্র‌তিকূলতা, জন্ম-মৃত্যু প্রভৃ‌তি সকলই সেই পরম‌প্রি‌য়ের নিকট হ‌তে প্রে‌রিত বার্তা । যখন আমরা এই দ্বন্ধমূলক বিষয়সমূহ গ্রহণীয় অথবা বর্জনীয় রূ‌পে না দে‌খে তা‌দের ঈশ্বর প্রেরিত প্রেম প্রসাদ ব‌লে গ্রহণ কর‌তে শি‌খি, তখনই যথার্থ ভ‌ক্তির উদয় হ‌য়ে‌ছে বলা য‌ায় ।
ঈশ্বর কৃপার প্রমাণ অনুকূল অথবা প্র‌তিকূল ঘটনার উপর নির্ভরশীল নয়, তার প্রমাণ আত্মশ‌ক্তির প‌রিচ‌য়ে, যা ঈশ্ব‌রের দান মাত্র । সেই দেবদত্ত শ‌ক্তি ব‌লে আনন্দ অথব‌া দুঃখ যাই আসুক না কেন, হা‌সিমু‌খে গ্রহণ করা সম্ভব হয় । ঈশ্বর সকল সম‌য়ে পরীক্ষা নেন আমাদের থে‌কে । যখন সু‌খে থা‌কি তখন ভু‌লে যায়, যখন দুঃখী হই তখন ম‌নে প‌ড়ে । কারণ ঈশ্বর‌কে ভু‌লে থাকার কার‌ণে কত কিছুর সম্মুখীন হ‌তে হয় ।




কৃষ্ণপ্রিয়া মীরা : পর্ব- ১


=======================

শৈশব ও প্রার‌ম্ভিক জীবন

=======================

ভারতব‌র্ষের ই‌তিহা‌সে মহাসা‌ধিকা মীরাবাঈ‌য়ের জীবন ঈশ্ব‌রের প্র‌তি সর্বগ্রাসী প্রে‌মের এক অত্যুজ্জ্বল দৃষ্টান্ত । মীরাবাঈ‌য়ের নাম স্মরণমাত্র ভক্তহৃদ‌য়ে ভ‌ক্তির প্রেরণা জাগায় ৷ মীরার জীব‌নে ভারতবর্ষ দে‌খে‌ছিল কৃ‌ষ্ণের প্র‌তি গোপী‌প্রে‌মের পুনরা‌বির্ভাব, যা তার মহান আধ্যা‌ত্মিক ধারা‌টি‌তে নব প্রাণ সঞ্চার করতে সাহায্য ক‌রে‌ছিল ।
ভারতব‌র্ষে লক্ষ লক্ষ মানু‌ষের ক‌ন্ঠে, দেবাল‌য়, ম‌ঠে, আখড়ায়, অসংখ্য পথ-চল‌তি পান্থ‌নিবা‌সে, এমন‌কি চল‌চ্চি‌ত্রে যদিও মীরার ভজন নিত্য‌দিন গীত হ‌য়ে চ‌লে‌ছে, তাঁর কোন প্রামা‌ণিক জীবন কিন্তু এখ‌নো পাওয়া যায়‌নি । অবশ্য অনুসন্ধান কার্য চল‌ছে । এখ‌া‌নে আমরা বি‌ভিন্ন কার‌ণে অ‌ধিকতর গ্রহণ‌যোগ্য ব‌লে ম‌নে হয় এমন এক‌টি জীবনীর অনুসরণ করব ।
১৫০৪ খ্রীষ্টা‌ব্দে রাজস্থা‌নের অন্তর্গত কুড়কী গ্রা‌মে, ক্ষত্রিয় বং‌শে, রতন সিং এর কন্যারূ‌পে মীরার জন্ম । রাজস্থা‌নের অবস্থান ভারতব‌র্ষের মধ্য-প‌শ্চিম অঞ্চ‌লে । ভারত ই‌তিহা‌সের বহু শৌর্যপূর্ণ কা‌হিনী রাজস্থা‌নের অ‌ধিবাসী বীর রাজপুত রমণী‌দের কেন্দ্র ক‌রে প্রচা‌রিত । ঊষর মরু প্র‌দে‌শে যোদ্ধাজা‌তির ম‌ধ্যে মীরার আবির্ভা‌বে অ‌ভিনবত্ব আ‌ছে । তি‌নিও বীর, ত‌বে যুদ্ধ‌ক্ষে‌ত্রে নয়, বীর রমণী তি‌নি ভ‌ক্তি‌তে, ভগবা‌নের চর‌ণে আত্ম‌নি‌বেদ‌নে ।
মাত্র তিন বৎসর বয়‌সে মীরা অ‌ধিকার ক‌রে‌ছিল তার জীব‌নের প্র‌তিমা‌টি‌কে, য‌া‌কে জগ‌তের কোন শ‌ক্তিই তার নিকট হ‌তে বি‌চ্ছিন্ন কর‌তে সমর্থ হয়‌নি । এক‌দিন এক সাধুভক্ত তাঁর পিত্রাল‌য়ে রা‌তের অ‌তি‌থিরূ‌পে আশ্রয় নি‌য়ে‌ছি‌লেন । তাঁর স‌ঙ্গে ছিল এক শ্রীকৃষ্ণমূ‌র্তি, গি‌রিধর গোপাল, যাঁ‌কে তি‌নি নিত্য পূজা কর‌তেন । রন সিং এর গৃ‌হে থাকাকা‌লে যখন এক‌দিন সাধু‌টি তাঁর ইষ্ট‌দেবতা গি‌রিধ‌রের পূজা কর‌ছেন, ছোট্ট মীরা উক্ত মূ‌র্তি‌টির প্র‌তি এক অপ্রতি‌রোধ্য আকর্ষণ অনুভব করল এবং তাঁ‌কে একান্ত নি‌জের ক‌রে পে‌তে চাইল ।
কিন্তু সাধুজী তাঁর উপাস্য দেবতা, যাঁ‌কে দীর্ঘকাল যাবৎ পূজা করে আস‌ছেন, হাতছাড়া কর‌তে রা‌জি নন । মীরা অনশন করার উপক্রম করল । ছোট শিশুর ভালবাসার প্রচণ্ড দা‌বি হৃদয় স্পর্শ না ক‌রে পা‌রে না । কিন্তু বাবাজীও তাঁর প্রা‌ণের দেবতা ‘গি‌রিধারী‌লাল’ ছাড়া অপর সব কিছুই দি‌তে প্রস্তুত । প্রে‌মের এই দ্ব‌ন্বে অব‌শে‌ষে মীরারই জয় হ‌লো । স্বয়ং ‘গি‌রিধারীলাল’ সাধুজী‌কে স্ব‌প্নের মাধ্যমে মীর‌ার কা‌ছে থাকার ইচ্ছা প্রকাশ কর‌লেন । সুতরাং অব‌শে‌ষে ব্য‌থিত হৃদ‌য়ে তাঁর দেবতা‌কে শেষবা‌রের ম‌তো নি‌মেষভা‌বে দর্শন ক‌রে সাধুজী ক‌ম্পিত হ‌স্তে গি‌রিধারীলালকে মীরার হা‌তে তু‌লে দি‌লেন । সজল চ‌ক্ষে তি‌নি ভগবানের অবোধ্য লীলার কথা ভাব‌তে ভা‌ব‌তে জনার‌ণ্যে অন্ত‌র্হিত হ‌লেন ।
শ্রীরামকৃ‌ষ্ণের জীবনী পাঠকরাও অবগত আ‌ছেন,‌ কেমন ক‌রে ঠিক অনুরূ‌পভা‌বে জটাধারী না‌মে এক বৈষ্ণব সাধু দ‌ক্ষি‌ণেশ্ব‌রে কিছু‌দি‌নের জন্য এ‌সে, তাঁর প্রিয় ‘রামলালা’ মূ‌র্তিখা‌নি শ্র‌ীরামকৃ‌ষ্ণের নিকট অর্পণ ক‌রে চ‌লে গে‌ছি‌লেন । তখনো জটাধারী‌কে ‘রামলালা’ স্ব‌প্নে দেখা দি‌য়ে শ্রীরামকৃ‌ষ্ণের নিকট থাকার আকা‌ঙ্ক্ষা প্রকাশ ক‌রে‌ছি‌লেন ।
ভক্ত ও ভগবা‌নের ম‌ধ্যে এই রহস্যপূর্ণ ভাব বি‌নিম‌য়ের অর্থ আমা‌দের প্রাকৃত জ‌নের বু‌দ্ধির অগম্য । কিন্তু তাই ব‌লে আমা‌দের ক্ষুদ্রবু‌দ্ধির উপর যেন অ‌ধিক আস্থা না রা‌খি এবং যা বু‌দ্ধির অগম্য, এমন ঘটনাসমূহ তুচ্ছজ্ঞা‌নে বা‌তিল না ক‌রে দিই । আধ্যাত্মিক অনুভূ‌তির অ‌ধিকাংশ ঘটনাই ঘ‌টে যু‌ক্তি-বু‌দ্ধির সীমানা ছা‌ড়ি‌য়ে । প্রে‌মের সেই দ্বন্ধযু‌দ্ধে জয়ী হয়ে মীরা যে কত আনন্দিত হ‌য়ে‌ছিল তা সহ‌জেই অনু‌মেয় । কিন্তু সেই গি‌রিধর মূর্তির মীরার বিরহ ও আন‌ন্দের কেন্দ্র হ‌য়ে ওঠার ব্যাপার‌টি কল্পনা করা আমাদের দুঃসাধ্য ৷
শিশুরা স্বভাবতই খুব চতুর । তারা জা‌নে কেমন ক‌রে বাবা-মা‌য়ের কাছ হ‌তে ঠোঁট ফু‌লি‌য়ে বায়না ক‌রে খেলনা আদায় কর‌তে হয় । এ‌ক্ষে‌ত্রে মীরা কিন্তু ছিল অস্বাভা‌বিক রকম জেদী ও আগ্রাসী । সে যা অধিকার করল তা, যেমন শিশুরা আগ্রহ ফু‌রি‌য়ে গে‌লে খেলনা ছুঁ‌ড়ে ফে‌লে দেয়, তেমন ক‌রে ত্যাগ করল না ৷
এই ঘটনার পর এক‌দিন বা‌ড়ির সাম‌নে দি‌য়ে যখন এক বিবাহ মি‌ছিল যাচ্ছে, মীরা তার মা‌কে জিজ্ঞাসা করল, “মা আমার দুল্-হা কোথায়?” ‘দুল্-হা’ অ‌র্থে বর অথবা প্রেমাস্পদও হয় ৷ শিশুর সরল ছে‌লেমানুষী দে‌খে মা হে‌সে গি‌রিধারীর মূ‌র্তির প্র‌তি অঙ্গু‌লি নি‌র্দেশ ক‌রে মীরা‌কে ব‌লে‌ছি‌লেন, “গি‌রিধারীলাল গোপালই তোমার দুল্-হা ৷” তি‌নি যখন একথা ব‌লে‌ছি‌লেন, তাঁর নিশ্চয় মীরার দেখা সেই স্বপ্নদৃ‌শ্যের কথা ম‌নে প‌ড়ে‌ছিল, যা মীরা তাঁ‌কে এক‌দিন ব‌লে‌ছিল । স্ব‌প্নে মীরা দে‌খে‌ছিল শ্রীকৃ‌ষ্ণের স‌ঙ্গে তার বিবাহ হ‌চ্ছে ।
যাই‌হোক, মা‌য়ের সেই কথা মীরা যে কত সত্য ব‌লে গ্রহণ ক‌রে‌ছিল তা আত্মীয় স্ব‌জনের বি‌স্মিত দৃ‌ষ্টির সম্মু‌খে তার বয়স বাড়ার স‌ঙ্গে স‌ঙ্গে ক্রমশই প্রকাশ হ‌তে থাকল । অন্ত‌রের ভাষা মীরা তাঁর র‌চিত ভজ‌নে চিরা‌য়িত ক‌রে রে‌খে‌ছেন—
‘মে‌রে তো গি‌রিধারী গোপাল দুসরা না কোঈ ।
যা‌কে শির মোর মুকুট মে‌রে প‌তি সোঈ . . . . ।’
অর্থাৎ আমার প্রভু গি‌রিধারী গোপাল ছাড়া আর তো কেউ নয়। যাঁর শি‌রে ময়ূর মুকট তিনিই যে আমার প‌তি।
আটবছর বয়‌সে মীরা মা‌কে হা‌রি‌য়ে তার ‘দুদাজী'র কা‌ছে চলে এল । তি‌নি ছি‌লেন পরম বৈষ্ণব ভক্ত । ঠাকুর্দার কো‌লে ব‌সে মীরা তন্ময় হ‌য়ে শুনত মহাভারত প্রভৃ‌তি পৌরা‌ণিক কা‌হিনী । মীরা কিন্তু ম‌নে ম‌নে সর্বদাই জা‌নে গি‌রিধারী গোপা‌লের স‌ঙ্গেই তার বিবাহ হ‌য়ে‌ছে । কিন্তু অপর কেউই সে ব্যাপা‌রে গুরুত্ব দেয়‌নি । ১৫১৬ খ্রীষ্টা‌ব্দে যখন মীরা ১৩ বছ‌রে পা দি‌ল, তার বাবা মেবা‌রের মহারাণা সংগ্রাম সিং‌হের পুত্র যুবরাজ ভোজরা‌জের স‌ঙ্গে মীরার বিবাহ দি‌লেন ।
শ্বশুরাল‌য়ে এ‌সে মীরা নিত্যই তার নতুন আত্মীয় প‌রিজন‌দের হতাশ কর‌তে লাগ‌লেন ৷ কুলপ্রথা হিসা‌বে নববধূ‌কে যখন রাজপ‌রিবা‌রের দেবী ম‌ন্দি‌রে নি‌য়ে যাওয়া হ‌লো, মীরা জানা‌লেন, তিতি গি‌রিধারী কৃষ্ণ ছাড়া অপর কাউ‌কে প্রণাম নি‌বেদন কর‌বেন না । সদ্যনতুন আত্মীয়দের নিকট মীরার এই অবাধ্যতার অর্থ বোধগম্য হ‌লো না । তি‌নি কি উন্মাদ অথবা ধর্মাদ্ধ ? রাজপ‌রিবা‌রের নিকট তি‌নি শ্রদ্ধাহীন ও উদ্ধত ব‌লে প্র‌তিভাত হ‌লেন ।
মীরার ন্যায় সা‌ধিকার মন সাধারণভা‌বে কাজ ক‌রে না । তি‌নি এমন এক‌টি প‌রি‌স্থি‌তির সম্মুখীন হ‌য়ে‌ছি‌লেন যখন, এক‌টি অনাবশ্যক ও অবাস্তব বিবাহ অনুষ্ঠান দ্বারা এক পরম বাস্ত‌বে দিব্য বিবাহ ব্যাপার‌কে সম্পূর্ণ বা‌তিল করার প্রয়াস হ‌চ্ছিল, সেই পুরু‌ষের প্র‌তি কোন অনুরাগ বা তাঁ‌কে প্র‌য়োজন এমন বোধ তাঁর হ‌চ্ছিল না । তি‌নি যে ই‌তিমধ্যেই তাঁর স্বামী, তাঁর সর্বস্ব গি‌রিধারী গোপাল‌কে তনু-মন-প্রাণ সমর্পণ ক‌রে দি‌য়ে‌ছেন । ঠিক এমনই মান‌সিকতার আ‌বে‌গে তি‌নি অপর দেবতার প্র‌তি ভ‌ক্তি প্রদর্শন করা‌কে দ্বিচারিণীর কর্ম ব‌লে ম‌নে ক‌রে‌ছি‌লেন । যে হৃদয়‌টি‌কে একজনের প্র‌তি নি‌বেদন ক‌রেই দি‌য়ে‌ছেন, তা কেমন ক‌রে পুনরায় অপর দেবতার প্র‌তি নি‌বেদন কর‌বেন ? তা কি কপটতা নয় ?
মীরার শ্বশুলা‌য়ের কুটুম্ব‌দের আশাভ‌ঙ্গের আ‌রো কা‌রণ,‌ তি‌নি যুবতী কন্যাসুলভ কোন ভোগবাসনায় উৎসাহ প্রকাশ ক‌রেন‌নি । রাজপুত সমা‌জে র‌জোগু‌ণের বি‌শেষ সমাদর, সেখা‌নে নারী দৈ‌হিক ও মান‌সিক ভোগ্যবস্তু ব‌লেই সর্বজনস্বীকৃত । কিন্তু মীরা সম্পূর্ণ অন্য প্রকৃ‌তির নারী । বিবা‌হের পর মীরার অ‌ধিকাংশ সময় ব্য‌য়িত হ‌তো পূজাগৃ‌হে গি‌রিধ‌রের সেবা-পূজা ও ভজন কীর্ত‌নে । অ‌ধিকন্তু তি‌নি সাধু-ভক্ত-জ্ঞানী‌দের নিমন্ত্রণ ক‌রে ধর্মসভার আসর ব‌সি‌য়ে নিয়ত তাঁ‌দের স‌ঙ্গে ধর্মচর্চা কর‌তে লাগ‌লেন । বলাবাহুল্য, তাঁর এরূপ জীবনধারার কোন‌টিই, রাজপ‌রিবারের পছন্দ হ‌লো না ।
মীরা‌কে আ‌দেশ দেওয়া হ‌লো, তি‌নি যেন এ সকল ত্যাগ ক‌রে রাজপ‌রিবা‌রের ঐ‌তিহ্য মে‌নে চ‌লেন, কিন্তু তা‌তে ফল হ‌লো না । তাঁর অন্ত‌রে আধ্যা‌ত্মিক তৃষ্ণা এতই তীব্র, সাধারণ গৃহীসুলভ জীবন যাপন করা তাঁর পক্ষে একান্তই অসম্ভব । সুতরাং তাঁর উপর ক‌ঠোর নি‌ষেধাজ্ঞা জা‌রি হলো । মীরা তাঁর স্বভাবসুলভ ভ‌ঙ্গি‌তে ভজ‌নের মাধ্য‌মে প্রকাশ কর‌লেন তাঁর প্র‌তি‌ক্রিয়া । এক‌টি গা‌নে তি‌নি গাই‌ছেন, ‘‘এ রাজপুরীর সকল প‌রিজন আমার সাধুসঙ্গ প্রিয়তার কার‌ণে আমা‌কে দি‌চ্ছে যন্ত্রণা, আমার পূজায় ঘটা‌চ্ছে বিঘ্ন । গি‌রিধর নাগর মীরার সখ্য ও প্রিয়তম, তার সে অনুরাগ তো ঘোচার নয়, তা যে উত্ত‌রোত্তর বাড়তেই থা‌কবে ।”




সাম্প্রতিক পোস্ট

পুরুষ—কৃষ্ণ ৷৷ প্রকৃতি—রাধা

 পুরুষ—কৃষ্ণ ৷৷ প্রকৃতি—রাধা ======================= যোগেনাত্মা সৃষ্টিবিধৌ দ্বিধারূপো বভূব সঃ ৷ পুমাংশ্চ দক্ষিণার্ধাঙ্গো বামাঙ্গঃ প্রকৃতিঃস্...

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ