শনিবার, ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৭

ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কি গীতা বিস্মৃত হন?



কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধকালে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনের নিকট যে গীতামৃত কীর্ত্তণ করেছিলেন, সেই পবিত্র গীতাজ্ঞান অর্জুন ভুলে গিয়ে অশ্বমেধপর্বে শ্রীকৃষ্ণের নিকট পুণরায় শুনতে চান । তখন ভগবান শ্রীকৃষ বলেন, “তুমি নিশ্চয় দুর্ম্মেধা, তাই আমার সেই সকল কথা স্মরণ রাখিতে পার নাই ৷” তিনি আরও বলিলেন—
পরম হি ব্রহ্ম কথিতং যোগযুক্তেন তন্ময়া।
ইতিহাসস্তু বক্ষ্যামি তস্মিন্নর্থে পুরাতনম্ ৷৷
অর্থাৎ— ‘তৎকালে আমি যোগযুক্ত হইয়া পরব্রহ্মের বিষয় বলিয়াছিলাম, এখন সেই বিষয়ে প্রাচীন বৃত্তান্ত বলিতেছি ৷’
(মহাভারত, আশ্বমেধিকপর্ব্ব, অনুগীতা)

লক্ষ্যণীয় যে, যোগ শব্দের নানা প্রকার অর্থ আছে ৷ এখানে কোন অর্থে যোগ-শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে তা স্পষ্ট লেখা আছে—
‘যোগযুক্তেন ঐক্যাগ্রসমন্বিতেন’ (ভারতকৌমুদী টীকা)
অর্থাৎ এখানে যোগযুক্ত অর্থ একাগ্রতার সহিত ৷
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যুদ্ধকালে অর্জুনকে যুদ্ধে প্রবৃত্ত করার জন্য যে সকল বাক্য ব্যয় করেছিলেন একাগ্রতার সহিত, তা আবার এখন পুণরোক্তি করবেন কিসের নিমিত্ত? তাছাড়া অর্জুন যে গীতা ভুলে গেছেন তার দুর্বল মেধাবশত, তাকে পুণরায় গীতা বললেও সে যে আবার ভুলে যাবে না তারই বা গ্যারান্টি কি? তাই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বললেন, “আমি সেই বিষয়ে তোমাকে প্রাচীন বৃত্তান্ত বলিতেছি ৷” অর্থাৎ সেই গীতাজ্ঞানই তিনি প্রকারন্তরে ইতিহাস গল্পের মাধ্যমে বলিবেন ৷ কেননা গল্পের মাধ্যমে যদি খুব কঠিন বিষয়ও আলোচনা করা হয়, তবে সেটা খুব সহজেই মনে রাখতে পারা যায়। এই জন্যই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সেই উপায়টি অবলম্বন করেন। পরবর্তীতে গীতাজ্ঞান জ্ঞান এইরুপে ভিন্নভাবে কথিত হওয়ায় একে ‘অনুগীতা’ বলা হয় ৷ অনুগীতা প্রদানের পর ভগবান বলিলেন—
পূর্বমপ্যেতদেবোক্তং যুদ্ধকাল উপস্থিতে।
ময়া তব মহাবাহো তস্মাদত্র মনঃ কুরু।।
(অশ্বমেধিকপর্ব, ৬৬/৭)
“মহাবাহু! পূর্বেই কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধের সময় উপস্থিত হইলে, আমি তোমার নিকট ভগবদগীতাস্বরূপ এই বিষয়ই বলিয়াছিলাম, অতএব তুমি এই বিষয়ে মনোনিবেশ কর।”
অতএব এইটা সুস্পষ্ট যে ভগবান যদিও সরাসরি ভাবে অর্জুনকে পুনরায় গীতা জ্ঞান প্রদান করতে অসম্মতি জানান তবুও ইতিহাসের মাধ্যমে ভগবান এখানে গীতার বিষয়ই তুলে ধরেছেন, যাতে করে অর্জুন সেই জ্ঞানটা আয়ত্ত করতে পারে ৷
.
এইরুপে সমগ্র বিষয়টি বুঝতে না পেরে অন্ধের হস্তিদর্শনের ন্যায় কিছু অকাল-কুষ্মান্ড মূর্খ বলে থাকে যে, শ্রীকৃষ্ণ সাধারণ মানুষ মাত্র, তিনি গীতা বিস্মৃত হয়েছিলেন, গীতা তাঁহার নিজস্ব উক্তি নয়, তিনি পরমাত্মার সহিত যোগযুক্ত হয়ে উহা বলেছিলেন ৷ সেই মূর্খদের উদ্দেশ্যে বলিতেছি, আপনারা যে অশ্বমেধপর্বের রেফারেন্স দিয়ে ঐসকল কথা বলিতেছেন, ঐ অশ্বমেধপর্বেই যুধিষ্টির শ্রীকৃষ্ণকে উদ্দেশ্য করে কি বলিতেছে দেখুন—
“হে বিশ্বকর্মন! হে বিশ্বাত্মন! হে বিশ্বশ্রেষ্ঠ! আমি মনে মনে তোমাকে যেরূপ ধারণা করি, কার্য্যদ্বারাও তোমাকে সেইরুপই জানিতেছি।”
“প্রভু মধুসূদন! অগ্নি সর্বদাই তোমার তেজ হইতে উৎপন্ন হন এবং রতি তোমারই ক্রিয়াস্বরূপা, আর স্বর্গ ও মর্ত তোমারই মায়া।”
(মহাভারত, অাশ্বমেধিকপর্ব ৬৭/৮-৯)
.
অতএব—
যশ্চ মানুষমাত্রোহ‘য়মিতি ব্রুয়াৎ স মন্দধীঃ ৷
হৃষীকেশমবিজ্ঞানাত্তমাহু পুরষাধমম্ ৷৷
—“যে লোক অজ্ঞানবশতঃ এই হৃষীকেশকে মানুষমাত্র বলিবে সে মন্দবুদ্ধি, সকলে তাকে ‘নরাধম’ বলিবে ৷”
(মহাভারত, ভীষ্মপর্ব, ৬৫/১৯)
.
সবশেষে—
সারথ্যমর্জুনস্যাজৌ কুর্ব্বন গীতামৃতং দদৌ ৷
লোকত্রয়োপকারায় তস্মৈ ব্রহ্মাত্মনে নমঃ ৷৷
“যিনি যুদ্ধে অর্জুনের সারথ্য করিতে প্রবৃত্ত হইয়া, ত্রিভূবনের উপকার করিবার জন্য অর্জুনকে গীতামৃত দান করিয়াছেন সেই পরমব্রহ্মরূপী কৃষ্ণকে নমষ্কার করি।”
(মহাভারত, শান্তিপর্ব ৪৬/১০৬)

[Reference book: মহাভারত, হরিদাশ সিদ্ধান্তবাগীশ]

সোমবার, ২৫ ডিসেম্বর, ২০১৭

বাংলা উপনিষদ ডাউনলোড

Download Pdf Upanishads in Bengali


                        ঈশোপনিষৎ

           [ Pdf Download Link : (Click here]


                          উপনিষদঃ 

          (তৈত্তিরেয়, ঐতরেয় ও শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ)
            [ Pdf Download Link: (Click here) ]



              উপনিষদ্ ভাবনা (১ম খন্ড)

              [ Pdf Download Link: (Click here) ]

                 উপনিষদ্ ভাবনা (২য় খন্ড)

             [ Pdf Download Link: (Click here) ]





শুক্রবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০১৭

শূদ্রবিরোধী দয়ানন্দ

দয়ানন্দ মতবাদ খন্ডন : পর্ব-৪


প্রশ্নঃ— বেদপাঠে কি শূদ্রের অধিকার আছে?
উত্তরঃ— আর্যসমাজের প্রতিষ্ঠাতা স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী যজুর্বেদ ২৬/২ দ্বারা সিদ্ধান্ত করেন যে, শূদ্রদেরও বেদপাঠে অধিকার আছে ৷
(সত্যার্থ-প্রকাশ, ৩য় সমুল্লাস)



প্রশ্নঃ— তবে শঙ্করাচার্যসহ সকল প্রচলিত ভাষ্যকারগণ তাদের ব্রহ্মসূত্র ভাষ্যে শূদ্রের প্রতি বেদপাঠ অধিকার নিষেধ করেছেন কেন?
উত্তরঃ— “যে স্থলে নিষেধ আছে সে স্থলে নিষেধের অভিপ্রায় এই যে, যাহাকে পড়াইলেও কিছুই শিখিতে পারে না, সে নির্ব্বোধ ও মূর্খ হওয়ায় তাকে ‘শূদ্র’ বলা হয় ৷ তাহার পড়া ও তাহাকে পড়ান নিষ্ফল ৷”— স্বামী দয়ানন্দ
(সত্যার্থ-প্রকাশ, ৩য় সমুল্লাস)


এখানে একটি বিষয় সমীক্ষার প্রয়োজন আছে ৷ দয়ানন্দ যজুর্বেদ (২৬৷২) দ্বারা শূদ্রেরও বেদ অধিকার প্রতিপাদন করেছেন ৷ কিন্তু এই তৃতীয় সমুল্লাসের প্রথম দিকেই সুশ্রুত সংহিতা হতে প্রমাণ উদ্ধৃত করে সিদ্ধান্ত করেছেন যে, শূদ্র কুলীন ও শুভ লক্ষণযুক্ত হলে “মন্ত্রসংহিতা” ব্যতীত সকল শাস্ত্র পড়তে পারবে ৷
(সত্যার্থ-প্রকাশ, ৩য় সমুল্লাস)


মন্ত্রসংহিতা কোনগুলো? দয়ানন্দ সপ্তম সমুল্লাসে বলেছেন- ঋক, সাম, যজুঃ ও অথর্ব— এইগুলো মন্ত্রসংহিতা, এগুলোই বেদ ৷ ইহা ব্যতীত অন্যকোন শাস্ত্র বেদ নয়! তাহলে ভাবুনতো, দয়ানন্দ কি আদৌ শূদ্রকে বেদে অধিকার দিয়েছে?
(সত্যার্থ-প্রকাশ, ৭ম সমুল্লাস)


দয়ানন্দের প্যাচঃ যজুর্বেদ ২৬/২ দ্বারা শূদ্রকে বেদাধিকার দিলেন→ সুশ্রুত সংহিতার বচন দ্বারা সিদ্ধান্ত করলেন শূদ্র মন্ত্রসংহিতা বাদে বাকি শাস্ত্র পড়বে→ স্বমত স্থাপন করলেন যে মন্ত্রসংহিতা ছাড়া বাকি শাস্ত্র বেদ নয়→ তাহলে যজুর্বেদ ২৬/২ দ্বারা কি করে বললেন যে শূদ্রও বেদ পড়তে পারবেন?

অতএব, দয়ানন্দকে শূদ্রবিরোধী বলবেন কিনা তা পাঠকগণ বিবেচনা করুন, কিন্তু তিনি যে স্ববিরোধী তা প্রমাণ হয়ে গেল ৷ তার এইরুপ স্ববিরোধীতার প্রমাণ আরো আছে, ক্রমে ক্রমে সেগুলো প্রকাশ করা হবে ৷ অনুসন্ধান করুন- কিভাবে দয়ানন্দ এরকম স্ববিরোধী প্রলাপ করতে পারে? অনুসন্ধান করলে জানতে পারবেন যে দয়ানন্দ গাঁজা-হুঁকো সেবন করতেন ৷ এইরকম স্ববিরোধিতা নেশাগ্রস্থ ব্যক্তি ছাড়া আর কে করতে পারে?



মঙ্গলবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০১৭

ন তস্য প্রতিমা অস্তি - প্রকৃত অর্থ বিশ্লেষণ

দয়ানন্দ মতবাদ খন্ডন : পর্ব-৩


‘ন তস্য প্রতিমা অস্তি যস্য নাম মহদযশঃ’ ৷
(শুক্লযজুর্বেদ ৩২৷৩)

বেদের এই মন্ত্রাংশটুকু তুলে ধরে আর্যসমাজের স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী (ও মুসলিমগণ) দাবি করে যে মূর্তিপূজা বেদ বিরোধী ৷ আসুন বিবেচনা করা যাক তার এই দাবি কতটুকু যুক্তিসংগত ৷

প্রথমতঃ অভিধানে ‘প্রতিমা’ শব্দের দুই প্রকার অর্থ পাওয়া যায় ৷ যথা—
১)  মূর্তি, বিগ্রহ, ভাস্কর্য 
২) তুল্য করা, পরিমাণ করা, সাদৃশ্য

এখন আমরা দেখব এই দুই প্রকার অর্থের মধ্যে কোনটি উক্ত মন্ত্রের অর্থ নির্ণয়ে যুক্তিযুক্ত ৷
(১) নং অর্থ গ্রহণ করলে উক্ত মন্ত্রের অর্থ দাড়ায়, ‘তাঁহার মূর্তি বা বিগ্রহ নাই যাঁহার নামে মহৎ যশ ৷’
একটু বিবেচনা করলেই বোঝা যাবে যে এই অর্থ মোটেই সংগত নয় ৷ কারণ মূর্তি কল্পনাই যদি যশস্বীদের যশের হানি করত তবে যতসব রাজ-মহারাজ, লাট, পন্ডিত, এমনকি স্বামী দয়ানন্দেরও যে মূর্তি তৈরী আছে তা দুষ্কৃতির স্তম্ভ বলেই বিবেচিত হতো ৷ জগতে যশস্বী ব্যক্তিগণেরই মূর্তি বা ভাস্কর্য তৈরী করে রাখা হয়, হীন ব্যক্তির নয় ৷
(২) নং অর্থ অনুসারে, ‘তাঁহার তুলনা বা সাদৃশ্য নাই যাঁহার নামে মহৎ যশ ৷’
একথাই কি যশস্বীকে বলা শোভা পায় না যে ‘আপনার তুল্য আর কেহ নাই’ ? কোন কথাতে যশস্বী খুশি হবেন তা আপনারা স্বয়ং বিচার করে দেখুন ৷

এখন উক্ত মন্ত্রের কয়েকটি ভাষ্যব্যাখ্যা, অনুবাদ দেখুন-

ন তস্য প্রতিমা অস্তি যস্য নাম মহদযশঃ ৷
হিরণ্যগর্ভ ইত্যেষ মা মা হিংসীদিত্যেষ যস্মান্ন জাত ইত্যেষঃ৷৷
[ শুক্ল-যজুর্বেদ ৩২৷৩ ]  

মহীধরভাষ্য: “তস্য” পুরুষস্য “প্রতিমা” প্রতিমানমুপমানং কি়ঞ্চিদ্বস্তু নাস্তি ... ৷ অর্থাৎ মহীধর এখানে প্রতিমা বলতে প্রতিমান উপমান বুঝিয়েছেন, মূর্তি বুঝাননি ৷

মিশ্রভাষ্য: (তস্য) সেই পুরুষের (প্রতিমা) প্রতিমান উপমান সদৃশ উপমা দেওয়ার যোগ্য কোনো বস্তু (ন, অস্তি) নাই ; (যস্য) যার (নাম) নাম প্রসিদ্ধ (মহৎ) বড় (যশঃ) যশ আছে অর্থাৎ সর্বাধিক তাঁর যশ ৷ এই বেদের “হিরণ্যগর্ভ ইত্যেষ” [২৫৷১০-১৩] “মা মা হিংসীদিত্যেষ” [১২৷১০২] এবং “যস্মান্ন জাত ইত্যেষা” [৮৷৩৬,৩৭] ইত্যাদি মন্ত্র দ্বারা তাঁকেই বর্ণনা করা হয়েছে ৷
“আধুনিক অল্পজ্ঞ ব্যক্তিগণ এই মন্ত্রে প্রতিমা অর্থ মূর্তি ধরে বলে যে, ঈশ্বরের কোন মূর্তি নেই আর মূর্তিপূজা উচিত নয় ৷”
      —পণ্ডিত শ্রীজ্বালাপ্রসাদ মিশ্র

✔বেদার্থপারিজাত ভাষ্যের সম্পাদক পণ্ডিত ব্রজবল্লভদ্বিবেদী দর্শনাচার্য প্রদত্ত মন্ত্রার্থ:—
সেই মহানারায়ণ পুরুষের কোন উপমান নেই অর্থাৎ তাঁর সহিত বরাবরী করতে পারে এমন কেউ নেই ৷ তাঁর নাম মহান যশ প্রদায়ক, এ বিষয়ে এই বেদই প্রমাণ ৷ যেমন- “হিরণ্যগর্ভঃ” (২৫৷১০), “মা মা হিংসীৎ” (১২৷১০২), “যস্নান্ন জাতঃ” (৮৷৩৬) ইত্যাদি শ্রুতি তাঁর মহান যশের বর্ণনা করে ৷

✔শ্রীপাদ দমোদার সাতবলেকর লিখেছেন:—
“তার কোন প্রতি-মা নেই এই কথা বলা তাৎপর্য এই যে তার বরাবর শক্তিশালী কেউ নেই৷” (যজুর্বেদকা সুবোধ ভাষ্য, পৃষ্ঠা ৫৪৩)

✔শ্রীবিজনবিহারী গোস্বামী কৃত বঙ্গানুবাদ:—
এ পুরুষের তুলনা দেবার কোন বস্তু নেই ৷ তার মহৎ যশ আছে ৷ ‘হিরণ্যগর্ভ’ ইত্যাদি, ‘আমাকে হিংসা করো না’ ইত্যাদি, ‘যা থেকে ইন্দ্র প্রভৃতি জাত, তিনি সম্রাট’ ইত্যাদি বাক্যে সে পুরুষকে বলা হয়েছে ৷


(যজুর্বেদ, শ্রীবিজনবিহারী গোস্বামী)


চতুর্ব্বেদ ভাষ্যকার শ্রীদূর্গাদাস লাহিড়ী শর্ম্মণ একস্থানে লিখেছেন— “পাশ্চাত্য-শিক্ষিত অনেকে, পাশ্চাত্য দর্শন-বিজ্ঞানের যুক্তিজাল বিন্যস্ত করিয়া, আমাদের প্রতিমা-পূজা প্রভৃতিকে নিষ্ফল হেয় প্রতিপন্ন করিতে প্রয়াস পান ৷ কিন্তু সে তাহাদের বিষম ভ্রান্তি ৷ কেননা, ঐ প্রতিমা-পূজার মধ্য দিয়াই প্রতিমার যিনি লক্ষ্যস্থল, তাঁহার নিকট পৌছানো যায় ৷ সমুদ্র যে কি, তাহা কখনও দেখি নাই; অথবা সমুদ্র যে কি, তাহা জানি না; কিন্তু যদি আমি জানি, এই নদীতেই সমুদ্রের রূপকণা আছে, আর এই নদীস্রোতের অনুগমন করিলেই সমুদ্রে উপনীত হওয়া যায়; তাহাতে, তদনুরূপ কর্মের ফলে, সমুদ্র-দর্শন বা সমুদ্রে মিলন আমার পক্ষে সম্ভবপর হইয়া আসে না কি? এজন্যই বলিতে হয়— যাহার যে পথ নির্দিষ্ট আছে, তিনি সেই পথ দিয়াই অগ্রসর হইতে আরম্ভ করুন, অগ্রসর হইতে হইতেই কেন্দ্রস্থানে উপনীত হইতে পারিবেন ৷”
(সামবেদ সংহিতা, প্রথম ৩৪২ সাম দ্রষ্টব্য)

দয়ানন্দের জ্ঞানের ন্যূনতা

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব আর্য-সমাজ প্রতিষ্ঠাতা স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী সম্পর্কে তার শিষ্যবর্গকে বলেছিলেন,

“সিঁতির বাগানে দেখতে গিয়েছিলাম; দেখলাম—একটু শক্তি হয়েছে; বুকটা সর্বদা লাল হয়ে রয়েচে; বৈখরী অবস্থা— দিনরাত চব্বিশ ঘন্টাই কথা (শাস্ত্রকথা) কচ্চে, ব্যাকরণ লাগিয়ে অনেক কথার (শাস্ত্রবাক্যের) মানে সব উল্টো-পাল্টা করতে লাগল; নিজে একটা কিছু করবো, একটা মত চালাব—এ অহংকার ভেতরে রয়েচে!”
(তথ্যসূত্র : শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণলীলাপ্রসঙ্গ, ৪র্থ খণ্ডের ২য় অধ্যায়, প্রসঙ্গ- গুরুভাব ও নানা সাধুসম্প্রদায়। ৯ম সংস্করণে পৃষ্ঠা- ১০৫)

অপরদিকে আর্যসমাজের স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী যখন শ্রীরামকৃষ্ণকে দেখলেন তখন তিনি নিজের জ্ঞানের ন্যূনতা অনুভব করে আক্ষেপ করে বললেন, “আমরা অনেক বেদ-বেদান্ত কেবল পড়েছি, কিন্তু এই মহৎ মানুষের মধ্যে তার প্রকাশ দেখতে পাচ্ছি ৷ এঁনাকে দেখে প্রমাণ হলো যে আমার মতো পন্ডিতেরা শাস্ত্র মন্থন করে কেবল ঘোলটাই খান, কিন্তু এঁনার মতো মহাপুরুষেরা মাখনটা খান ৷”
(শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত ১৷১৩৷৫)


ভাবতে অবাক লাগে যে, দয়ানন্দ তার ক্ষুদ্র জ্ঞান নিয়ে মূর্তিপূজার বিরোধীতা করেছেন, বলেছেন যে মূর্তিপূজা বেদ-বিরোধী ৷ অথচ তিনি যাঁর মধ্যে সমগ্র বেদ-বেদান্তের প্রকাশ দেখতে পেয়েছেন সেই শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছেনঃ—
“মাটির প্রতিমাকে ভগবান ভেবে পূজা করা যদি ভুলই হয়ে থাকে তো যিনি এই বিশ্বব্রহ্মান্ড চালাচ্ছেন, তিনি কি এইটুকু জানেন না যে এই পূজার লক্ষ্য তিনি ৷ ভগবান এই বিভিন্ন রকমের পূজার প্রচলন করেছেন ভিন্ন ভিন্ন প্রকৃতির লোকদের উপযোগী হবে বলে ৷ মা যেমন জানেন তাঁর কোন্ ছেলের কোন্ খাদ্য উপযোগী, ঠিক তেমনি ভগবান জানেন—কার পক্ষে কোনটি উপযুক্ত পথ ৷ তাই তাঁকে চিন্তা করবার এই ভিন্ন ভিন্ন সাধন পদ্ধতি তিনি নিজেই সৃষ্টি করেছেন ৷”
(শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত-প্রসঙ্গ, ১ম ভাগ, পৃঃ ৫০)


ব্রহ্ম প্রতিমা



রূপং রূপং প্রতিরূপো বভুব
             তদস্য রূপং প্রতিচক্ষণায় ৷
ইন্দ্রো মায়াভিঃ পুরুরূপ ঈয়তে
           যুক্তা হস্য হরয়াঃ শতা দশ ৷৷ঋগ্বেদ ৬.৪৭.১৮৷৷
অনুবাদঃ “রুপে রুপে প্রতিরুপ (তাহার অনুরুপ) হইয়াছেন, সেই ইহার রুপকে প্রতিখ্যাপনের (জ্ঞাপনের) জন্য ৷ ইন্দ্র মায়াসমূহের দ্বারা বহুরুপ প্রাপ্ত হন ৷ যুক্ত আছে ইহার অশ্ব শত দশ (অর্থাৎ সহস্র) ৷”


অগ্নির্যথৈকো ভুবনং প্রবিষ্টো রূপং রূপং প্রতিরূপো বভুব৷
একস্তথা সর্বভূতান্তরাত্মা রূপং রূপং প্রতিরূপো বহিশ্চ৷৷
“অগ্নি যেমন এক হয়েও ভুবনের মধ্যে প্রবেশ করে রুপে রুপে বহুরুপ হয়ে আপনাকে ধরে দিয়েছে, তেমনি সর্বভূতের অন্তরস্থ অন্তরাত্মা এক হয়েও বাহির অবধি ভিন্ন ভিন্ন রুপ গ্রহণ করেছে ৷” (কঠঃ ২৷২৷৯)
.
বায়ুর্যথৈকো ভুবনং প্রবিষ্টো রূপং রূপং প্রতিরূপো বভুব৷
একস্তথা সর্বভূতান্তরাত্মা রূপং রূপং প্রতিরূপো বহিশ্চ৷৷
“বায়ু যেমন এক হয়েও ভুবনের মধ্যে প্রবেশ করে রুপে রুপে বহুরুপ হয়ে আপনাকে ধরে দিয়েছে, তেমনি সর্বভূতের অন্তরস্থ অন্তরাত্মা এক হয়েও বাহির অবধি ভিন্ন ভিন্ন রুপ গ্রহণ করেছে ৷” (কঠঃ ২৷২৷১০)
.
“রূপং রূপং প্রতিরূপো বভুব৷ অয়মত্মা ব্রহ্ম সর্ব্বানুভূঃ৷”
অর্থাৎ তিনি প্রতি বস্তুর রুপ ধারণ করিয়াছেন ৷ এই আত্মাই ব্রহ্ম ৷ তিনি সর্ব্বগত ৷ (বৃহদারণ্যক, ২৷৫৷১৯)
.
একো বশী সর্বভূতান্তরাত্মা একং রূপং বহুধা যঃ করোতি৷
“একক নিয়ন্তা হয়েও এই সর্বভূতের অন্তরাত্মা একই রুপকে বহুধা করে চলেছে ৷” (কঠঃ ২৷২৷১২)
.
“যো বিশ্বস্য প্রতিমানং বভুব” (ঋগ্বেদ ২৷১২৷৯)
অর্থাৎ—তিনি নিখিলের প্রতিমা হইয়াছিলেন ৷


সুতরাং দেখা যাচ্ছে, ন তস্য প্রতিমা অস্তি অর্থাৎ ঈশ্বরের তুল্য কেহ না থাকলেও, ঈশ্বর কিন্তু সকলের তুল্য হইতে পারেন, যেকোন রুপ পরিগ্রহ করতে পারেন ৷ তাই ভক্ত-সাধক ঈশ্বরকে যে-প্রতিমাতেই পূজা করুক না কেন, তিনি সেই মূর্তিরূপেই ভক্তকে দেখা দিবেন ৷
“বায়ু যেমন পার্থিব পঙ্কজাদির গন্ধ, রেণুর বর্ণ ধারণ করিয়া নানাগন্ধ ও রুপবিশিষ্ট হয়, তেমনি সর্বদেহের অন্তর্যামী পরমাত্মা শ্রীভগবান উপাসকের বাসনা অনুযায়ী তাদের সম্মুখে আবির্ভূত হন, সেই পরমেশ্বরই আমার মনোরথ পূর্ণ করুন, অন্য দেবতা আশ্রয়ের প্রয়োজন কি?” (শ্রীমদ্ভাগবত ৬৷৪৷৩৪)
.
নমস্তে দেবদেবেশ! শঙ্খচক্রগদাধর ৷
ভক্তেচ্ছোপাত্তরুপায়­ পরমাত্মন্! নমোহস্তু তে ৷৷
নমঃ পঙ্কজনাভায় নমঃ পঙ্কজমালিনে ৷
নমঃ পঙ্কজনেত্রায় নমস্তে পঙ্কজাঙ্ঘ্রয়ে ৷৷
— “হে দেবদেব, হে সর্বেশ্বর, শঙ্খ-চক্র-গদাধারী আপনাকে নমস্কার ! হে পরমাত্মা, আপনি ভক্তগণের ইচ্ছানুরুপ রুপ ধারণ করিয়া থাকেন, আপনাকে নমস্কার ৷ পদ্মনাভ আপনাকে নমস্কার, পদ্মমালাধারী আপনাকে নমস্কার, কমল-নয়ন আপনাকে নমস্কার, কমল-চরণ আপনাকে নমস্কার ৷” (শ্রীমদ্ভাগবত ১০৷৫৯৷২৫-২৬)


আরো পড়ুন- 1) প্রতিমাপূজার শাস্ত্রীয় প্রমাণ
2) ন তস্য প্রতিমা অস্তি 




রবিবার, ১০ ডিসেম্বর, ২০১৭

কে বড়? শিব না বিষ্ণু?




সাধ্যানামপি দেবানাং দেবেদেবেশ্বরঃ প্রভুঃ।
লোকভাবনভাবজ্ঞ ইতি ত্বাং নারদোহব্রবীৎ।।
—“নারায়ণ! আপনি দেবগণ এবং সাধ্যগণেরও প্রভু দেবদেব ব্রহ্মা এবং শিবেরও অধীশ্বর, আর আপনি লোকের মনের ভাব জানেন, ইহা নারদ বলিয়াছেন।”
(মহাভারত, ভীষ্মপর্ব ৬৭/২, অনুবাদক—হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ)
                                  ↑↑↓↓
স এস রুদ্রভক্তশ্চ কেশবো রুদ্রসম্ভবঃ।
সর্ব্বরুপং ভবং জ্ঞাত্বা লিঙ্গে যো আর্চ্চয়ত প্রভুম্।।
—“যিনি জগদীশ্বর শিব কে সর্ব্বময় জানিয়া তাঁহার লিঙ্গে পূজা করিতেন, তিনি শিবাংশ জাত ও শিব ভক্ত সেই নারয়ণ এই হচ্ছেন শ্রীকৃষ্ণ ৷”
(মহাভারত, দ্রোণ পর্ব্ব ১৬৯/৬২, অনুবাদক— ঐ)

এই শ্লোকদুটি নিয়ে কতিপয় শৈব ও বৈষ্ণবগণকে পরস্পর সংঘর্ষে লিপ্ত হতে দেখা যায় ৷ আপতদৃষ্টিতে শ্লোকদুটি পরস্পর বিরোধী মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে এতে কোন বিরোধ নাই ৷ সমাধান দেখুন-
মহাভারতের পরিশিষ্ট হরিবংশ (অধ্যায়-১৮৩) হতে বর্ণিত—‘রুদ্রদেবের উপাস্য যেমন বিষ্ণু, বিষ্ণুর উপাস্যও তদ্রুপ রুদ্রদেব ৷ ইঁহারা উভয়েই একাত্মা, দৃশ্যতঃ দ্বিধাভূত হইয়া নিত্য জগতে বিচরণ করিতেছেন ৷ শঙ্কর হইতে বিষ্ণু ভিন্ন নহে, বিষ্ণু হইতেও রুদ্র ভিন্ন নহে ৷’

অর্থাৎ শিব ও বিষ্ণু স্বরুপতঃ এক, তথাপিও লোকশিক্ষার নিমিত্তি দ্বিধাভূত হয়ে একে অপরের উপাসক হন ৷

অহং ব্রহ্মা চ শর্ব্বশ্চ জগতঃ কারণং পরম্ ৷
আত্মেশ্বর উপদ্রষ্টা স্বয়ংদৃগবিশেষণঃ ৷৷
শ্রীভগবান বিষ্ণু বলিলেন—‘আমিই জগতের কারণ, আত্মা, ঈশ্বর, সাক্ষী, স্বপ্রকাশ এবং উপাধিশূণ্য, এবং আমিই ব্রহ্মা ও শিবরুপ ধারণ করিয়া থাকি ৷’
(শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণ ৪৷৭৷৫০)

ব্রহ্মা বিষ্ণুর্মহেশোহমুমা স্কন্দো বিনায়কঃ |
ইন্দ্রোঽগ্নিশ্চ যমশ্চাহং নিঋতির্বরুণোঽনিলঃ ||
ভগবান শিব বলিলেন— ‘আমি ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ, উমা, স্কন্দো, বিনায়ক ৷ আমি ইন্দ্র, অগ্নি এবং যম ৷ আমি নিঋতি, বরুণ ও বায়ু ৷’ (শিবগীতা ৬৷২২)


 অতএব আসুন, সকলে এই প্রার্থনা করি—
যথা শিবময়ো বিষ্ণুবেরং বিষ্ণুময়ঃ শিবঃ ৷
যথান্তরং ন পশ্যামি তথা মে স্বস্তিরাুযুষি ৷৷
অর্থাৎ—‘বিষ্ণু যে প্রকার শিবময়, শিবও সে প্রকার বিষ্ণুময় ৷ আমার জীবন এমন মঙ্গলময় হোক যেন ইঁহাদের মধ্যে পার্থক্য না দেখি ৷’ (স্কন্দোপনিষৎ, ৯)
‘(I bow) to Shiva of the form of Vishnu and  Vishnu who is Shiva; Vishnu is Shiva’s  heart and Shiva, Vishnu’s. Just as Vishnu is  full of Shiva, so is Shiva full of Vishnu. As I see no difference, I am well all my life.’ (Skanda Upanishad, 8 - 9)



শুক্রবার, ১ ডিসেম্বর, ২০১৭

শঙ্করাচার্য ও বেদান্ত-দর্শন

বেদান্ত দর্শনের মাহাত্ম্য


অামাদের সনাতনধর্মের গ্রন্থ ভান্ডারে রয়েছে ছয়টি দর্শন শাস্ত্র ৷ এই ষড়দর্শনগুলো হচ্ছে—

১) বৈশেষিক দর্শন —আচার্য কণাদ
২) ন্যায়দর্শন  —মহর্ষি গৌতম
৩) সাংখ্যদর্শন —কপিল মুনি
৪) যোগদর্শন —মহর্ষি পাতঞ্জল
৫) পূর্বমীমাংসা বা কর্মমীমাংসা দর্শন —মহর্ষি জৈমনি
৬) বেদান্তদর্শন বা ব্রহ্মসূত্র —মহর্ষি বাদরায়ণ ব্যাসদেব

 প্রথম চারটি দর্শনের পর পূর্বমীমাংসা এবং শেষে হয় বেদান্তদর্শন পড়তে হয় । কেননা ঐগুলো প্রথমে বুঝে নিলে বেদান্তদর্শন বুঝতে সহজ হয় ৷ পূর্ব-মীমাংসায় বর্ণিত হয়েছে কর্মমার্গ, আর বেদান্তদর্শনে বর্ণিত হয়েছে জ্ঞানমার্গ ৷ কর্মমার্গের অনুসারীদের কর্মবাদী ও জ্ঞানমার্গের অনুসারীদের বলা হয় জ্ঞানবাদী ৷ আদিগুরু শঙ্করাচার্যের সময় পূর্বমীমাংসক বা কর্মবাদীদের বলা হতো প্রধানমল্ল । কারণ তখন মীমাংসা দর্শনের এতো শক্তিশালী প্রভাব ছিল যে যদি কেউ মীমাংসকদের হারিয়ে দিতে পারে তাহলে ধরে নিতে হবে জগতের যতো দর্শন অাছে সবাইকে সে হারিয়ে দিয়েছে; যেমন ধরুন কলকাতার সবথেকে বড় মল্লবীরকে যদি চেন্নাইয়ের কোন মল্লবীর হারিয়ে দেয় তাহলে সে কলকাতার সব মল্লবীরকে হারিয়ে দিয়েছে সেটা মানতে হবে ৷

কর্মমীমাংসকদের হারাতে গিয়ে জ্ঞানবাদী শঙ্করাচার্যকে খুব কঠিন কঠিন শক্তির মুখোমুখি হতে হয়েছিল। প্রথমে তিনি খোজ নিলেন মীমাংসকদের প্রধান কে? খোজ নিয়ে জানলেন যে তাদের প্রধান হলেন কুমারিল ভট্ট । এক ব্রাহ্মণের কাছে তিনি কুমারিল ভট্টের জীবনকথা বিস্তারিত শুনলেন ৷ কুমারিলের অপূর্ব জীবনকথা শুনে শঙ্করাচার্য মুগ্ধ হয়ে শিষ্যসহ কুমারিলের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলেন ৷ কুমারিল ভট্টকে যখন শঙ্করাচার্য খুজে পেলে তখন কুমারিল ভট্ট একটা প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য তুষের অাগুনে নিজেকে অাত্মাহুতি দিয়ে মৃত্যুর অপেক্ষা করছেন । কুমারিল ভট্ট বৌদ্ধ ধর্মকে জানার জন্য নিজের ধর্ম ত্যাগ করে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন । বৌদ্ধ ধর্মকে ভালো করে জেনে বুঝে, এদের দূর্বলতা ও দোষ ক্রুটিকে অায়ত্ত করে নিয়ে পরে তিনি বৌদ্ধ ধর্মকে অাক্রমণ করলেন, অার এমন ভাবে অাক্রমণ করলেন যে সারা ভারতে বৌদ্ধধর্মকে একেবারে নস্যাৎ করে ছেড়ে দিলেন । কিন্তু নিজের ধর্মকে ছেড়ে যেহেতু বিধর্মী হয়েছিলেন সেই পাপের প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য তিনি নিজেকে তুষাগ্নিতে অাহুতি দিয়ে তিল তিল করে পুড়তে থাকেন, অার মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করেন । ঐ সময় শঙ্করাচার্য তাঁকে গিয়ে বললেন, “অামি অাপনার অতুলনীয় পান্ডিত্যশক্তির কথা শুনে আপনার কাছে এসেছি। আমি ব্রহ্মসূত্রের অদ্বৈতমতের পোষক ভাষ্য রচনা করেছি ৷ ইচ্ছা ছিল যদি আপনি আমার এই মতবাদ গ্রহণ করেন এবং ইহার ওপর একটি বার্ত্তিক রচনা করে দেন তবে এই অদ্বৈতমত নির্দোষভাবে জগতে প্রতারিত হতো ৷”
কুমারিল ভট্ট শঙ্করাচার্যকে তখন বলেন, “অামারতো এই অবস্থা দেখছো, অামি তো এখনো পুড়ছি তোমার সঙ্গে কি অার বাদ-বিচার করবো! তবে মিথিলাতে অামার পরম শিষ্য মণ্ডন মিশ্র অাছে, তুমি ওকে গিয়ে বিতর্কে যদি হারাতে পারো ও তোমার মত যদি সে গ্রহণ করে তবে তা আমিও গ্রহণ করেছি বলে বুঝে নিবে ৷”

শঙ্করাচার্য কুমারিল ভট্টের মৃত্যু অবধি সেখানেই অপেক্ষা করলেন, এবং মৃত্যুর পর ক্রিয়াকর্মাদি করে মিথিলাতে গিয়ে মণ্ডন মিশ্রকে সরাসরি তর্কে অাহ্বান জানালেন। সাত দিন ধরে এই তর্ক চলছিল এবং সাতদিন পর মণ্ডন মিশ্র শঙ্করাচার্যের মতের সহিত আপোষ করেন ও তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন । পরবর্তী কালে শঙ্করাচার্যের প্রধান চার শিষ্যের মধ্যে মণ্ডন মিশ্র একজন হয়ে উঠলেন। অার তাঁর নাম হয় সুরেশ্বরাচার্য। মণ্ডন মিশ্রকে যেদিন শঙ্করাচার্য অবনত করলেন সেদিন থেকে ভারতবর্ষের প্রধান দর্শন হয়ে গেলো বেদান্ত । শঙ্করাচার্যের পর প্রায় তেরশো বছর ভারতের উপর দিয়ে অতিবাহিত হয়ে গিয়েছে কিন্তু কেউ এখনো পর্যন্ত বেদান্তকে হারাতে পারেনি । বেদান্তের অনেক শাখা প্রশাখা অাছে- দ্বৈতবাদ, অদ্বৈতবাদ, বিশিষ্ট্যদ্বৈতবাদ, অচিন্ত্যভেদাভেদভাদ ইত্যাদি অার এদের মধ্যে প্রচন্ড বাকবিতণ্ডা লেগে থাকে, কিন্তু অন্য দর্শন বা অন্য ধর্ম অাক্রমণ করলে এরা সবাই এক জোট হয়ে পাল্টা অাক্রমণ করে।

(শঙ্করাচার্য ও মন্ডন মিশ্র)


                         Related post : কুমারিল ভট্টের জীবনী


দয়ানন্দ মতবাদ খন্ডন : পর্ব-২

মোক্ষ বিষয়ক বিচার

আর্যসমাজের স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতীর দাবি হচ্ছে মুক্তি বা মোক্ষপ্রাপ্ত জীবকেও পুণরায় সংসারে ফিরে আসতে হয় ৷ এবিষয়ে উক্ত মহাশয় যে প্রমাণ উপস্থাপন করেন তা এই—

[১]
কস্য নূনং কতমস্যামৃতানাং মনামহে চারু দেবস্য নাম।
কো নো মহ্যা অদিতয়ে পুনর্দাত পিতরং চ দৃশোয়ং মাতরং চ।।
(ঋগবেদ ১।২৪।১)
.
পদার্থঃ আমরা (কস্য) কিভাবে গুন কর্ম স্বভাব যুক্ত (কতমস্য) কোন বহু (অমৃতানাম্) উৎপত্তি বিনাশরহিত অনাদি মোক্ষপ্রাপ্ত জীবের (দেবস্য) প্রকাশমান সর্বোত্তম সুখের দানকারী দেবের নিশ্চয়ের সাথে (চারু) সুন্দর (নাম) প্রসিদ্ধ নাম কে (মনামহে) জানিব যিনি (নূনম্) নিশ্চয় করে (কঃ) কোন সুখস্বরূপ দেব (নঃ) মোক্ষ প্রাপ্ত আমাদের কে (মহৈ) বিশাল কারণরূপ নাশরহিত (অদিতয়ে) পৃথিবীর মধ্যে (পুনঃ) পুনর্জন্ম দান করেন, যাহাতে আমরা (পিতরম্) পিতা (চ) এবং (মাতরম্) মাতা (চ) এবং স্ত্রি পুত্র বন্ধু আদি কে (দৃশেয়ম্) দেখতে পারি।।
.
সরলার্থঃ আমরা কিরূপ গুন কর্ম স্বভাব যুক্ত কোন বহু উৎপত্তি বিনাশরহিত অনাদি মোক্ষপ্রাপ্ত জীবের প্রকাশমান সর্বোত্তম সুখের দানকারী দেবের নিশ্চয়ের সাথে সুন্দর প্রসিদ্ধ নাম কে জানিব যিনি নিশ্চয় করে কোন সুখস্বরূপ দেব মোক্ষকে প্রাপ্ত আমাদের কে বিশাল কারণরূপ নাশরহিত পৃথিবীর মধ্যে পুনর্জন্ম দান করেন, যাহাতে আমরা পিতা এবং মাতা এবং স্ত্রি পুত্র বন্ধু আদি কে দেখতে পারি।।
.
অগ্নের্বয়ং প্রথমস্যামৃতানাং মনামহে চারু দেবস্য নাম।
স তো মহ্যা অদিতয়ে পূনর্দাৎপিতরং চ দৃশয়ে মাতরং চ।।
(ঋগবেদ ১।২৪।২)
.
পদার্থঃ আমরা যেই (অগ্নে) জ্ঞানস্বরূপ (অমৃতানাম্) বিনাশ ধর্মরহিত পদার্থ বা মোক্ষ প্রাপ্ত জীবের (প্রথমস্য) অনাদি বিস্তৃত অদ্বিতীয় স্বরূপ (দেবস্য) সমস্ত জগতের প্রকাশকারী বা সংসারের সমস্ত পদার্থের দানকারী পরমেশ্বরের (চারু) পবিত্র (নাম) গুণের গান করতে (মনামহে) জানি, (সঃ) তিনিই (নঃ) আমাদের (মহৈ) বড় বড় গুন সম্পন্ন (অদিতয়ে) পৃথিবীর মধ্যে (পূনঃ) পুনরায় জন্ম (দাত্) দান করেন, যাহাতে আমরা (পুনঃ) পুনরায় (পিতরম্) পিতা (চ) এবং (মাতরম্) মাতা (চ) এবং স্ত্রী পুত্র বন্ধু আদিকে (দৃশ্যেয়ম্) দেখতে পারি।। ২।।
.
সরলার্থঃ আমরা যেই জ্ঞানস্বরূপ বিনাশ ধর্মরহিত পদার্থ বা মোক্ষ প্রাপ্ত জীবের অনাদি বিস্তৃত অদ্বিতীয় স্বরূপ সমস্ত জগতের প্রকাশকারী বা সংসারের সমস্ত পদার্থের দানকারী পরমেশ্বরের পবিত্র গুণের গান করতে জানি, তিনিই আমাদের বড় বড় গুন সম্পন্ন পৃথিবীর মধ্যে পুনরায় জন্ম দান করেন, যাহাতে আমরা পুনরায় পিতা এবং মাতা এবং স্ত্রী পুত্র বন্ধু আদিকে দেখতে পারি।। ২।।

[2]
বেদান্তবিজ্ঞানসূনিশ্চিতার্থঃ সন্নাসযোগাদ্ যতয়ঃ শূদ্ধসত্বাঃ।
তে ব্রহ্মলোকেষু পরান্তকালে পরামৃতাঃ পরিমূচ্যন্তি সর্বে।।
(মুন্ডুক ৩৷২৷৬)
.
শব্দার্থঃ (বেদান্তবিজ্ঞানসূনিশ্চিতার্থাঃ) বেদান্তের পুস্তক দ্বারা উৎপন্ন হওয়া যে জ্ঞান অর্থাৎ উপনিষদ্ এবং বেদান্তের দর্শন দ্বারা যে জ্ঞান উৎপন্ন হয়, তাহা দ্বারা যে অর্থ কে নিশ্চয় করে নেয় (সন্ন্যাসযোগাত্) বৈরাগ্য দ্বারা অর্থাৎ প্রত্যেক সাংসারিক বস্তুতে দোষ জানার দ্বারা অথবা যোগাভ্যাস দ্বারা মন কে রুদ্ধ করার দ্বারা (যতয়ঃ) যিনি ইন্দ্রীয় কে বশ করে নেয়, ইহা দ্বারা (শুদ্ধসত্ত্বাঃ) বুদ্ধি কে সব প্রকার দোষ দ্বারা শুদ্ধ করে নেয় (তে) তিনি জ্ঞানী পুরুষ (ব্রহ্মলোকেষু) ব্রহ্মলোক অর্থাৎ ব্রহ্মদর্শনে (পরান্তকালে) মহা কল্পের সীমা পর্যন্ত অথবা পরাবিদ্যার দ্বারা উৎপন্ন হওয়া শুদ্ধ সুখের অন্ত কাল পর্যন্ত (পরামৃতাঃ) পরা বিদ্যা দ্বারা মুক্ত জীব (পরিমুচ্যন্তি) সেই অবস্থা থেকে মুক্ত হয়ে যায় (সর্বে) সব।

/////////////////////////////////////////////////

এখন সত্যানুসন্ধানী সুধীগণ লক্ষ্য করুন—
[১] আমরা জানি সংস্কৃত ‘নঃ’ শব্দের অর্থ ‘আমাদের’, দেখুন উপর্যুক্ত ঋগ্বেদ ১৷২৪৷২ এ ‘নঃ’ অর্থ ‘আমাদেরকে’ এইরুপ প্রকৃত অর্থই লেখা হয়েছে, কিন্তু ঋগ্বেদ ১৷২৪৷১ লিখেছে ‘মোক্ষপ্রাপ্ত আমাদের কে’!!! এখানে মোক্ষপ্রাপ্ত শব্দটিকে অতিরিক্ত সংযোজন করা হয়েছে ও দয়ানন্দের মনগোড়া মতবাদের সাথে মিলাতে গিয়ে মন্ত্রটার অর্থ টানা-বুনা করা হয়েছে ৷ কিরকম টানাবুনা করা হয়েছে দেখুন- উক্ত অনুবাদে ‘অমৃতনাম’ অর্থ লেখা হয়েছে মোক্ষপ্রাপ্ত জীবের ৷ কিন্তু মূল মন্ত্রের পদগুলো অন্বয় করলে হয় ‘অমৃতনাম দেবস্য’ অর্থাৎ এখানে দেবগণকেই অমৃত নামে অভিহিত করা হয়েছে ৷
আর্যসমাজী তুলসীরামও কিন্তু মন্ত্রটার অর্থ এতটা বিকৃত করতে দুঃসাহস করেননি, তিনি দয়ানন্দের অনুসারী হয়েও কিন্তু মোক্ষপ্রাপ্ত হয়ে ফেরত পাঠানোর কথা লেখেননি ৷ কারণ তিনি জানেন যে দয়ানন্দ এখানে স্পষ্টত ভুল ৷ তার অনুবাদ দেখুন-


আর্যসমাজী সত্যপ্রকাশ সরস্বতী ও সত্যকাম বিদ্যালঙ্কারও কিন্তু তাদের অনুবাদে মোক্ষ হতে ফেরত আসার কথা লেখেননি ৷ তাদের অনুবাদ-
“আমাকে বলো, বিশ্বজগতের এত সংখ্যক অমৃত দেবগণের মধ্যে কে স্ব-প্রকাশ? কার মহিমা আমরা অনুধ্যান করিব? এবং একটি পূর্ণ জীবন অতিবাহিত করার পর কে আমাদেরকে পৃথিবীতে ছাড়িয়া দিইবে যাহাতে পুণরায় জন্মগ্রহণ করিয়া পিতা-মাতাকে দর্শন করিতে পারি?” (১)
“যিনি সর্বাগ্রে উপাস্য পরমেশ্বর, যাহার পবিত্র নাম আমরা অনুধ্যান করি— তিনি আমাদিগকে পৃথিবীতে ছাড়িয়া দিবেন যাহাতে পুণরায় জন্মগ্রহণ করিয়া পিতা-মাতাকে দর্শন করিতে পারি ৷” (২)


রমেশচন্দ্র দত্ত অনুবাদ করেছেন-
১। দেবগণের মধ্যে কোন শ্রেণীর কোন দেবের চারু নাম উচ্চারণ করব? কে আমাকে এ মহতী পৃথিবীতে আবার ছেড়ে দেবেন? যে আমি পিতা ও মাতাকে দর্শন করতে পারি?
২। দেবগণের মধ্যে প্রথম অগ্নিদেবের চারুনাম উচ্চারণ করি; তিনি আমাকে এ মহতী পৃথিবীতে ছেড়ে দিন, যেন আমি পিতাকে ও মাতাকে দর্শন করতে পারি।

দেখুন, এখানে মোক্ষ বিষয়ক কোন কথাই নাই ৷ অথচ দয়ানন্দ ভুলভাল অনুবাদ করেছে নিজের মতবাদ রক্ষার্থে ৷ এতে গীতা-উপনিষদ সাংঘর্ষিক হয়ে যায় ৷ সঠিক অর্থ গ্রহণ করলে সর্বশাস্ত্রে সমন্বয় হয় ৷ কারণ গীতা-উপনিষদে বারংবার বলা হয়েছে যে ভগবানকে প্রাপ্ত হলে বা মোক্ষপ্রাপ্তি হলে সংসারে ফিরতে হয় না ৷ কিন্তু স্বর্গ-নরক ক্ষণস্থায়ী, তা থেকে ফেরত আসতে হয় ৷ অতএব উক্ত মন্ত্রদ্বয়ে স্বর্গ বা নরক হতে ফিরে তথা জন্মান্তরে মাতা-পিতার মাধ্যমে পুণরায় জন্মগ্রহণ করাা বুঝতে হবে ৷ স্বয়ং ভগবানের মুখঃনিসৃত বাণী ‘শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা’ হতে প্রমাণ দেখুন-


ত্রিবেদোক্ত যজ্ঞাদিকর্মপরায়ণ ব্যক্তিগণ যজ্ঞাদি দ্বারা আমার পূজা করিয়া যজ্ঞশেষে সোমরস পানে নিষ্পাপ হন এবং স্বর্গলাভ কামনা করেন, তাঁহারা পবিত্র স্বর্গলোক প্রাপ্ত হইয়া দিব্য দেবভোগসমূহ ভোগ করিয়া থাকেন । (৯/২০)
তাঁহারা তাঁহাদের প্রার্থিত বিপুল স্বর্গসুখ উপভোগ করিয়া পুণ্যক্ষয় হইলে পুনরায় মর্ত্যলোকে প্রবেশ করেন । এইরূপে কামনাভোগ-পরবশ এই ব্যক্তিগণ যাগযজ্ঞাদি বেদোক্ত ধর্ম অনুষ্ঠান করিয়া পুনঃ পুনঃ সংসারে যাতায়াত করিয়া থাকেন । (৯/২১)

যোগভ্রষ্ট পুরুষ পুণ্যকর্মকারীদিগের প্রাপ্য স্বর্গলোকাদি প্রাপ্ত হইয়া তথায় বহু বৎসর বাস করিয়া পরে সদাচার সম্পন্ন ধনীর গৃহে জন্মগ্রহণ করেন । (৬/৪১)
পক্ষান্তরে, যোগভ্রষ্ট পুরুষ জ্ঞানবান্‌ যোগীদিগের কুলে জন্মগ্রহণ করেন । জগতে ঈদৃশ জন্ম অতি দুর্লভ । (৬/৪২)
হে কুরুনন্দন, যোগভ্রষ্ট পুরুষ সেই জন্মে পূর্বজন্মের অভ্যস্ত মোক্ষবিষয়ক বুদ্ধি লাভ করেন এবং মুক্তিলাভের জন্য পুনর্বার যত্ন করেন । (৬/৪৩)
তিনি অবশ হইয়াই পূর্বজন্মের যোগাভ্যাসজনিত শুভ সংস্কারবশতঃ যোগমার্গে আকৃষ্ট হন । যিনি কেবল যোগের স্বরূপ-জিজ্ঞাসু, তিনিই বেদোক্ত কাম্যকর্মাদির ফল অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ফল লাভ করেন (যিনি যোগের স্বরূপ জানিয়া যোগাভ্যাস-পরায়ণ তাঁহার আর কথা কি ?) ৷ (৬/৪৪)

হে ভরতর্ষভ যে কালে (মার্গে) গমন করিলে যোগিগণ পুনর্জন্ম প্রাপ্ত হন না এবং যে কালে গমন করিলে পুনর্জন্ম প্রাপ্ত হন তাহা বলিতেছি । (৮/২৩)
অগ্নির্জ্যোতি, দিন, শুক্ল পক্ষ, উত্তরায়ণ ছয়মাস - এই সময় (এই দেবতাগণের লক্ষিত পথে গমন করিয়া) ব্রহ্মোপাসকগণ ব্রহ্মকে প্রাপ্ত হন । (৮/২৪)
ধূম, রাত্রি, কৃষ্ণপক্ষ, দক্ষিণায়ন ছয় মাস এই সময়ে অর্থাৎ এই সকল দেবতাগণের লক্ষিত পথে গমন করিয়া কর্মী পুরুষ স্বর্গলোক প্রাপ্ত হইয়া তথায় কর্মফল ভোগ করতঃ পুনরায় সংসারে পুনরাবৃত্ত হন । (৮/২৫)
জগতের শুক্ল (প্রকাশময়) ও কৃষ্ণ (অন্ধকারময়) এই দুইটি পথ অনাদি বলিয়া প্রসিদ্ধ । একটি দ্বারা মোক্ষ লাভ হয়, অপরটি দ্বারা পুনর্জন্ম লাভ করিতে হয় । (৮/২৬)

যে পদ প্রাপ্ত হইলে সাধক আর সংসারে প্রত্যাবর্তন করেন না, যে পদ সূর্য, চন্দ্র বা অগ্নি প্রকাশ করিতে পারে না, তাহাই আমার পরম স্বরূপ । (১৫/৬)

এই জ্ঞান আশ্রয় করিয়া যাঁহারা আমার সাধর্ম্য লাভ করেন অর্থাৎ ত্রিগুণাতীত অবস্থা প্রাপ্ত হন, তাঁহারা সৃষ্টিকালেও জন্মগ্রহণ করেন না, প্রলয়কালেও ব্যথিত হন না (অর্থাৎ জন্ম-মৃত্যু অতিক্রম করেন) । (১৪/২)
[অনুবাদক— শ্রীজগদীশচন্দ্র ঘোষ]

অতএব, গীতা ১৪/২ অনুসারে কল্পান্তরেও মোক্ষপ্রাপ্ত জীবকে পুণরায় সংসারে ফিরে আসতে হয় না ৷



[২] ঋগ্বেদের উক্ত মন্ত্রটির মতো মুন্ডুক উপনিষদের (৩৷২৷৬) মন্ত্রটির অর্থও টানাবুনা করা হয়েছে ৷ মন্ত্রটির সহজ ও স্বাভাবিক অর্থ দেখে নিন—
(উপনিষদ, গোরক্ষপুর গীতাপ্রেস)

(উপনিষদঃ, শ্রীসীতানাথ দত্ত)





“...এষ দেবপথো ব্রহ্মপথঃ, এষেন প্রতিপদ্যমানা ইমং মানবমাবর্ত্তং নাবর্ত্তন্তে নাবর্ত্তন্তে ৷৷” (ছান্দোগ্য, ৪/১৫/৫)
“...ইহাই দেবপথ ও ব্রহ্মপথ, এই পথের দ্বারা যাঁহারা গমন করেন, তাঁহার এই মানব আবর্ত্তে অর্থাৎ সংসারসাগরে পুনরায় আবর্ত্তন করেন না অর্থাৎ ফিরিয়া আসেন না অর্থাৎ তাঁহাদের আর পুনর্জ্জন্ম হয় না ৷”


সুতরাং পরমেশ্বর এমন কোন ধরাবাঁধা নিয়ম জারি করে রাখেননি যে মোক্ষপ্রাপ্ত জীবকে সেই নিয়মের বশবর্তী হয়ে বাধ্য হয়ে পৃথিবীতে ফিরে আসতে হবে ৷ অতএব দয়ানন্দ ভ্রান্ত ও তার আসুরিক মত নিরাকরণ করা হলো ৷


সাম্প্রতিক পোস্ট

পুরুষ—কৃষ্ণ ৷৷ প্রকৃতি—রাধা

 পুরুষ—কৃষ্ণ ৷৷ প্রকৃতি—রাধা ======================= যোগেনাত্মা সৃষ্টিবিধৌ দ্বিধারূপো বভূব সঃ ৷ পুমাংশ্চ দক্ষিণার্ধাঙ্গো বামাঙ্গঃ প্রকৃতিঃস্...

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ