শুক্রবার, ১ ডিসেম্বর, ২০১৭

দয়ানন্দ মতবাদ খন্ডন : পর্ব-২

মোক্ষ বিষয়ক বিচার

আর্যসমাজের স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতীর দাবি হচ্ছে মুক্তি বা মোক্ষপ্রাপ্ত জীবকেও পুণরায় সংসারে ফিরে আসতে হয় ৷ এবিষয়ে উক্ত মহাশয় যে প্রমাণ উপস্থাপন করেন তা এই—

[১]
কস্য নূনং কতমস্যামৃতানাং মনামহে চারু দেবস্য নাম।
কো নো মহ্যা অদিতয়ে পুনর্দাত পিতরং চ দৃশোয়ং মাতরং চ।।
(ঋগবেদ ১।২৪।১)
.
পদার্থঃ আমরা (কস্য) কিভাবে গুন কর্ম স্বভাব যুক্ত (কতমস্য) কোন বহু (অমৃতানাম্) উৎপত্তি বিনাশরহিত অনাদি মোক্ষপ্রাপ্ত জীবের (দেবস্য) প্রকাশমান সর্বোত্তম সুখের দানকারী দেবের নিশ্চয়ের সাথে (চারু) সুন্দর (নাম) প্রসিদ্ধ নাম কে (মনামহে) জানিব যিনি (নূনম্) নিশ্চয় করে (কঃ) কোন সুখস্বরূপ দেব (নঃ) মোক্ষ প্রাপ্ত আমাদের কে (মহৈ) বিশাল কারণরূপ নাশরহিত (অদিতয়ে) পৃথিবীর মধ্যে (পুনঃ) পুনর্জন্ম দান করেন, যাহাতে আমরা (পিতরম্) পিতা (চ) এবং (মাতরম্) মাতা (চ) এবং স্ত্রি পুত্র বন্ধু আদি কে (দৃশেয়ম্) দেখতে পারি।।
.
সরলার্থঃ আমরা কিরূপ গুন কর্ম স্বভাব যুক্ত কোন বহু উৎপত্তি বিনাশরহিত অনাদি মোক্ষপ্রাপ্ত জীবের প্রকাশমান সর্বোত্তম সুখের দানকারী দেবের নিশ্চয়ের সাথে সুন্দর প্রসিদ্ধ নাম কে জানিব যিনি নিশ্চয় করে কোন সুখস্বরূপ দেব মোক্ষকে প্রাপ্ত আমাদের কে বিশাল কারণরূপ নাশরহিত পৃথিবীর মধ্যে পুনর্জন্ম দান করেন, যাহাতে আমরা পিতা এবং মাতা এবং স্ত্রি পুত্র বন্ধু আদি কে দেখতে পারি।।
.
অগ্নের্বয়ং প্রথমস্যামৃতানাং মনামহে চারু দেবস্য নাম।
স তো মহ্যা অদিতয়ে পূনর্দাৎপিতরং চ দৃশয়ে মাতরং চ।।
(ঋগবেদ ১।২৪।২)
.
পদার্থঃ আমরা যেই (অগ্নে) জ্ঞানস্বরূপ (অমৃতানাম্) বিনাশ ধর্মরহিত পদার্থ বা মোক্ষ প্রাপ্ত জীবের (প্রথমস্য) অনাদি বিস্তৃত অদ্বিতীয় স্বরূপ (দেবস্য) সমস্ত জগতের প্রকাশকারী বা সংসারের সমস্ত পদার্থের দানকারী পরমেশ্বরের (চারু) পবিত্র (নাম) গুণের গান করতে (মনামহে) জানি, (সঃ) তিনিই (নঃ) আমাদের (মহৈ) বড় বড় গুন সম্পন্ন (অদিতয়ে) পৃথিবীর মধ্যে (পূনঃ) পুনরায় জন্ম (দাত্) দান করেন, যাহাতে আমরা (পুনঃ) পুনরায় (পিতরম্) পিতা (চ) এবং (মাতরম্) মাতা (চ) এবং স্ত্রী পুত্র বন্ধু আদিকে (দৃশ্যেয়ম্) দেখতে পারি।। ২।।
.
সরলার্থঃ আমরা যেই জ্ঞানস্বরূপ বিনাশ ধর্মরহিত পদার্থ বা মোক্ষ প্রাপ্ত জীবের অনাদি বিস্তৃত অদ্বিতীয় স্বরূপ সমস্ত জগতের প্রকাশকারী বা সংসারের সমস্ত পদার্থের দানকারী পরমেশ্বরের পবিত্র গুণের গান করতে জানি, তিনিই আমাদের বড় বড় গুন সম্পন্ন পৃথিবীর মধ্যে পুনরায় জন্ম দান করেন, যাহাতে আমরা পুনরায় পিতা এবং মাতা এবং স্ত্রী পুত্র বন্ধু আদিকে দেখতে পারি।। ২।।

[2]
বেদান্তবিজ্ঞানসূনিশ্চিতার্থঃ সন্নাসযোগাদ্ যতয়ঃ শূদ্ধসত্বাঃ।
তে ব্রহ্মলোকেষু পরান্তকালে পরামৃতাঃ পরিমূচ্যন্তি সর্বে।।
(মুন্ডুক ৩৷২৷৬)
.
শব্দার্থঃ (বেদান্তবিজ্ঞানসূনিশ্চিতার্থাঃ) বেদান্তের পুস্তক দ্বারা উৎপন্ন হওয়া যে জ্ঞান অর্থাৎ উপনিষদ্ এবং বেদান্তের দর্শন দ্বারা যে জ্ঞান উৎপন্ন হয়, তাহা দ্বারা যে অর্থ কে নিশ্চয় করে নেয় (সন্ন্যাসযোগাত্) বৈরাগ্য দ্বারা অর্থাৎ প্রত্যেক সাংসারিক বস্তুতে দোষ জানার দ্বারা অথবা যোগাভ্যাস দ্বারা মন কে রুদ্ধ করার দ্বারা (যতয়ঃ) যিনি ইন্দ্রীয় কে বশ করে নেয়, ইহা দ্বারা (শুদ্ধসত্ত্বাঃ) বুদ্ধি কে সব প্রকার দোষ দ্বারা শুদ্ধ করে নেয় (তে) তিনি জ্ঞানী পুরুষ (ব্রহ্মলোকেষু) ব্রহ্মলোক অর্থাৎ ব্রহ্মদর্শনে (পরান্তকালে) মহা কল্পের সীমা পর্যন্ত অথবা পরাবিদ্যার দ্বারা উৎপন্ন হওয়া শুদ্ধ সুখের অন্ত কাল পর্যন্ত (পরামৃতাঃ) পরা বিদ্যা দ্বারা মুক্ত জীব (পরিমুচ্যন্তি) সেই অবস্থা থেকে মুক্ত হয়ে যায় (সর্বে) সব।

/////////////////////////////////////////////////

এখন সত্যানুসন্ধানী সুধীগণ লক্ষ্য করুন—
[১] আমরা জানি সংস্কৃত ‘নঃ’ শব্দের অর্থ ‘আমাদের’, দেখুন উপর্যুক্ত ঋগ্বেদ ১৷২৪৷২ এ ‘নঃ’ অর্থ ‘আমাদেরকে’ এইরুপ প্রকৃত অর্থই লেখা হয়েছে, কিন্তু ঋগ্বেদ ১৷২৪৷১ লিখেছে ‘মোক্ষপ্রাপ্ত আমাদের কে’!!! এখানে মোক্ষপ্রাপ্ত শব্দটিকে অতিরিক্ত সংযোজন করা হয়েছে ও দয়ানন্দের মনগোড়া মতবাদের সাথে মিলাতে গিয়ে মন্ত্রটার অর্থ টানা-বুনা করা হয়েছে ৷ কিরকম টানাবুনা করা হয়েছে দেখুন- উক্ত অনুবাদে ‘অমৃতনাম’ অর্থ লেখা হয়েছে মোক্ষপ্রাপ্ত জীবের ৷ কিন্তু মূল মন্ত্রের পদগুলো অন্বয় করলে হয় ‘অমৃতনাম দেবস্য’ অর্থাৎ এখানে দেবগণকেই অমৃত নামে অভিহিত করা হয়েছে ৷
আর্যসমাজী তুলসীরামও কিন্তু মন্ত্রটার অর্থ এতটা বিকৃত করতে দুঃসাহস করেননি, তিনি দয়ানন্দের অনুসারী হয়েও কিন্তু মোক্ষপ্রাপ্ত হয়ে ফেরত পাঠানোর কথা লেখেননি ৷ কারণ তিনি জানেন যে দয়ানন্দ এখানে স্পষ্টত ভুল ৷ তার অনুবাদ দেখুন-


আর্যসমাজী সত্যপ্রকাশ সরস্বতী ও সত্যকাম বিদ্যালঙ্কারও কিন্তু তাদের অনুবাদে মোক্ষ হতে ফেরত আসার কথা লেখেননি ৷ তাদের অনুবাদ-
“আমাকে বলো, বিশ্বজগতের এত সংখ্যক অমৃত দেবগণের মধ্যে কে স্ব-প্রকাশ? কার মহিমা আমরা অনুধ্যান করিব? এবং একটি পূর্ণ জীবন অতিবাহিত করার পর কে আমাদেরকে পৃথিবীতে ছাড়িয়া দিইবে যাহাতে পুণরায় জন্মগ্রহণ করিয়া পিতা-মাতাকে দর্শন করিতে পারি?” (১)
“যিনি সর্বাগ্রে উপাস্য পরমেশ্বর, যাহার পবিত্র নাম আমরা অনুধ্যান করি— তিনি আমাদিগকে পৃথিবীতে ছাড়িয়া দিবেন যাহাতে পুণরায় জন্মগ্রহণ করিয়া পিতা-মাতাকে দর্শন করিতে পারি ৷” (২)


রমেশচন্দ্র দত্ত অনুবাদ করেছেন-
১। দেবগণের মধ্যে কোন শ্রেণীর কোন দেবের চারু নাম উচ্চারণ করব? কে আমাকে এ মহতী পৃথিবীতে আবার ছেড়ে দেবেন? যে আমি পিতা ও মাতাকে দর্শন করতে পারি?
২। দেবগণের মধ্যে প্রথম অগ্নিদেবের চারুনাম উচ্চারণ করি; তিনি আমাকে এ মহতী পৃথিবীতে ছেড়ে দিন, যেন আমি পিতাকে ও মাতাকে দর্শন করতে পারি।

দেখুন, এখানে মোক্ষ বিষয়ক কোন কথাই নাই ৷ অথচ দয়ানন্দ ভুলভাল অনুবাদ করেছে নিজের মতবাদ রক্ষার্থে ৷ এতে গীতা-উপনিষদ সাংঘর্ষিক হয়ে যায় ৷ সঠিক অর্থ গ্রহণ করলে সর্বশাস্ত্রে সমন্বয় হয় ৷ কারণ গীতা-উপনিষদে বারংবার বলা হয়েছে যে ভগবানকে প্রাপ্ত হলে বা মোক্ষপ্রাপ্তি হলে সংসারে ফিরতে হয় না ৷ কিন্তু স্বর্গ-নরক ক্ষণস্থায়ী, তা থেকে ফেরত আসতে হয় ৷ অতএব উক্ত মন্ত্রদ্বয়ে স্বর্গ বা নরক হতে ফিরে তথা জন্মান্তরে মাতা-পিতার মাধ্যমে পুণরায় জন্মগ্রহণ করাা বুঝতে হবে ৷ স্বয়ং ভগবানের মুখঃনিসৃত বাণী ‘শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা’ হতে প্রমাণ দেখুন-


ত্রিবেদোক্ত যজ্ঞাদিকর্মপরায়ণ ব্যক্তিগণ যজ্ঞাদি দ্বারা আমার পূজা করিয়া যজ্ঞশেষে সোমরস পানে নিষ্পাপ হন এবং স্বর্গলাভ কামনা করেন, তাঁহারা পবিত্র স্বর্গলোক প্রাপ্ত হইয়া দিব্য দেবভোগসমূহ ভোগ করিয়া থাকেন । (৯/২০)
তাঁহারা তাঁহাদের প্রার্থিত বিপুল স্বর্গসুখ উপভোগ করিয়া পুণ্যক্ষয় হইলে পুনরায় মর্ত্যলোকে প্রবেশ করেন । এইরূপে কামনাভোগ-পরবশ এই ব্যক্তিগণ যাগযজ্ঞাদি বেদোক্ত ধর্ম অনুষ্ঠান করিয়া পুনঃ পুনঃ সংসারে যাতায়াত করিয়া থাকেন । (৯/২১)

যোগভ্রষ্ট পুরুষ পুণ্যকর্মকারীদিগের প্রাপ্য স্বর্গলোকাদি প্রাপ্ত হইয়া তথায় বহু বৎসর বাস করিয়া পরে সদাচার সম্পন্ন ধনীর গৃহে জন্মগ্রহণ করেন । (৬/৪১)
পক্ষান্তরে, যোগভ্রষ্ট পুরুষ জ্ঞানবান্‌ যোগীদিগের কুলে জন্মগ্রহণ করেন । জগতে ঈদৃশ জন্ম অতি দুর্লভ । (৬/৪২)
হে কুরুনন্দন, যোগভ্রষ্ট পুরুষ সেই জন্মে পূর্বজন্মের অভ্যস্ত মোক্ষবিষয়ক বুদ্ধি লাভ করেন এবং মুক্তিলাভের জন্য পুনর্বার যত্ন করেন । (৬/৪৩)
তিনি অবশ হইয়াই পূর্বজন্মের যোগাভ্যাসজনিত শুভ সংস্কারবশতঃ যোগমার্গে আকৃষ্ট হন । যিনি কেবল যোগের স্বরূপ-জিজ্ঞাসু, তিনিই বেদোক্ত কাম্যকর্মাদির ফল অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ফল লাভ করেন (যিনি যোগের স্বরূপ জানিয়া যোগাভ্যাস-পরায়ণ তাঁহার আর কথা কি ?) ৷ (৬/৪৪)

হে ভরতর্ষভ যে কালে (মার্গে) গমন করিলে যোগিগণ পুনর্জন্ম প্রাপ্ত হন না এবং যে কালে গমন করিলে পুনর্জন্ম প্রাপ্ত হন তাহা বলিতেছি । (৮/২৩)
অগ্নির্জ্যোতি, দিন, শুক্ল পক্ষ, উত্তরায়ণ ছয়মাস - এই সময় (এই দেবতাগণের লক্ষিত পথে গমন করিয়া) ব্রহ্মোপাসকগণ ব্রহ্মকে প্রাপ্ত হন । (৮/২৪)
ধূম, রাত্রি, কৃষ্ণপক্ষ, দক্ষিণায়ন ছয় মাস এই সময়ে অর্থাৎ এই সকল দেবতাগণের লক্ষিত পথে গমন করিয়া কর্মী পুরুষ স্বর্গলোক প্রাপ্ত হইয়া তথায় কর্মফল ভোগ করতঃ পুনরায় সংসারে পুনরাবৃত্ত হন । (৮/২৫)
জগতের শুক্ল (প্রকাশময়) ও কৃষ্ণ (অন্ধকারময়) এই দুইটি পথ অনাদি বলিয়া প্রসিদ্ধ । একটি দ্বারা মোক্ষ লাভ হয়, অপরটি দ্বারা পুনর্জন্ম লাভ করিতে হয় । (৮/২৬)

যে পদ প্রাপ্ত হইলে সাধক আর সংসারে প্রত্যাবর্তন করেন না, যে পদ সূর্য, চন্দ্র বা অগ্নি প্রকাশ করিতে পারে না, তাহাই আমার পরম স্বরূপ । (১৫/৬)

এই জ্ঞান আশ্রয় করিয়া যাঁহারা আমার সাধর্ম্য লাভ করেন অর্থাৎ ত্রিগুণাতীত অবস্থা প্রাপ্ত হন, তাঁহারা সৃষ্টিকালেও জন্মগ্রহণ করেন না, প্রলয়কালেও ব্যথিত হন না (অর্থাৎ জন্ম-মৃত্যু অতিক্রম করেন) । (১৪/২)
[অনুবাদক— শ্রীজগদীশচন্দ্র ঘোষ]

অতএব, গীতা ১৪/২ অনুসারে কল্পান্তরেও মোক্ষপ্রাপ্ত জীবকে পুণরায় সংসারে ফিরে আসতে হয় না ৷



[২] ঋগ্বেদের উক্ত মন্ত্রটির মতো মুন্ডুক উপনিষদের (৩৷২৷৬) মন্ত্রটির অর্থও টানাবুনা করা হয়েছে ৷ মন্ত্রটির সহজ ও স্বাভাবিক অর্থ দেখে নিন—
(উপনিষদ, গোরক্ষপুর গীতাপ্রেস)

(উপনিষদঃ, শ্রীসীতানাথ দত্ত)





“...এষ দেবপথো ব্রহ্মপথঃ, এষেন প্রতিপদ্যমানা ইমং মানবমাবর্ত্তং নাবর্ত্তন্তে নাবর্ত্তন্তে ৷৷” (ছান্দোগ্য, ৪/১৫/৫)
“...ইহাই দেবপথ ও ব্রহ্মপথ, এই পথের দ্বারা যাঁহারা গমন করেন, তাঁহার এই মানব আবর্ত্তে অর্থাৎ সংসারসাগরে পুনরায় আবর্ত্তন করেন না অর্থাৎ ফিরিয়া আসেন না অর্থাৎ তাঁহাদের আর পুনর্জ্জন্ম হয় না ৷”


সুতরাং পরমেশ্বর এমন কোন ধরাবাঁধা নিয়ম জারি করে রাখেননি যে মোক্ষপ্রাপ্ত জীবকে সেই নিয়মের বশবর্তী হয়ে বাধ্য হয়ে পৃথিবীতে ফিরে আসতে হবে ৷ অতএব দয়ানন্দ ভ্রান্ত ও তার আসুরিক মত নিরাকরণ করা হলো ৷


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

সাম্প্রতিক পোস্ট

পুরুষ—কৃষ্ণ ৷৷ প্রকৃতি—রাধা

 পুরুষ—কৃষ্ণ ৷৷ প্রকৃতি—রাধা ======================= যোগেনাত্মা সৃষ্টিবিধৌ দ্বিধারূপো বভূব সঃ ৷ পুমাংশ্চ দক্ষিণার্ধাঙ্গো বামাঙ্গঃ প্রকৃতিঃস্...

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ