বৃহস্পতিবার, ২৬ অক্টোবর, ২০১৭

কৃষ্ণপ্রিয়া মীরা : পর্ব-২


=====================

আহ্বান ও মীরার সাড়া

=====================

১৫২৩ খ্রীষ্টা‌ব্দে মীরার বয়স যখন মাত্র স‌তে‌রো, তাঁর স্বামী ভোজরাজ দেহত্যাগ কর‌লেন । কোন কোন জীব‌নী‌তে ভোজরা‌জকে চি‌ত্রিত করা হ‌য়ে‌ছে একজন ঈর্ষাপরায়ণ স্বামীরূপে ৷ যি‌নি মীরার প্রবল ঈশ্বরানুর‌ক্তি— যা তাঁ‌কে মধুর দাম্পত্য সুখ হ‌তে ব‌ঞ্চিত ক‌রে‌ছে, তার প্র‌তি বি‌দ্বেষযুক্ত হ‌য়ে স্ত্রী মীরার প্র‌তি অত্যন্ত ক‌ঠোর ব্যবহার কর‌তেন । আবার কেউ কেউ এরূপ ধ‌ারণার বি‌রো‌ধিতা করে‌ছেন, তাঁ‌দের ম‌তে ভোজরাজ একজন বিরহী স্বামী, যি‌নি স্ত্রী‌কে অত্যন্ত ভালবাস‌লেও তাঁর হৃদয় লা‌ভে অসমর্থ হ‌য়ে‌ছি‌লেন, কারণ মীরার মন সম্পূর্ণতই ভগবৎ প্রে‌মে বাঁধা প‌ড়েছিল ।
যাই‌হোক, স্বামীর মৃত্যুর পর মীরার জীব‌নের এক নতুন অধ্যায় শুরু হলো । সে অধ্যায়‌টি তাঁর জীব‌নে মহা পরীক্ষার এবং সেই স‌ঙ্গে তা সাফ‌ল্যেরও ব‌টে । ক‌থিত আ‌ছে, এইসময় তি‌নি রইদাস নামক এক বৈষ্ণব সাধুর নিকট মন্ত্রদীক্ষা গ্রহণ ক‌রেন । তাঁর বৈধব্য অ‌তি স্বাভাবিকভা‌বেই তাঁর আধ্যা‌ত্মিক সাধনা তীব্রতর ক‌রে‌ছিল । এখন গুরুর নিকট নির্দিষ্ট পথ‌নি‌র্দেশ লাভ ক‌রে তাঁর ব্যাকুলতা, তন্ময়তা, সাধুসঙ্গ লা‌ভের জন্য তীব্র স্পৃহা, গতানুগ‌তিক সাংসা‌রিক জীব‌নের প্র‌তি প্রবল বিতৃষ্ণা প্রভৃ‌তি অনন্তগু‌ণে বৃ‌দ্ধি পেল এবং সে সকল অহরহ তাঁকে উত্ত্যক্ত কর‌তে থাকল ।
ইতিম‌ধ্যে শ্বশুর সংগ্রাম সিং‌হের মৃত্যু হ‌য়ে‌ছে এবং ভোজরা‌জের ভ্রাতা কুমার বিক্রম‌জিৎ রাণা চি‌তো‌রের সিংহাস‌নে আ‌রোহণ ক‌রে‌ছেন । তি‌নি মীরার প্র‌তি ক‌ঠোর নিয়ম জা‌রি কর‌তে বিন্দুমাত্র বিলম্ব কর‌লেন না । কিন্তু মীরার সাধনভজন একান্তভা‌বেই তাঁর নিজস্ব ধারায় অগ্রসর হ‌তে থাকল ।
তিনি গি‌রিধারী গোপা‌লের সম্মু‌খে নৃত্য কর‌তেন, আপ্লুত হৃদ‌য়ে ভজন নি‌বেদন করেন । স‌াধুসঙ্গ লা‌ভের সু‌যোগ তো কিছুমাত্রও হারান না ।
সাধুসঙ্গ লা‌ভের তৃষ্ণা তাঁর এতই তীব্র ছিল যে, রাজপরিবা‌রের প্রথাগত বি‌ধি‌নিয়ম সকল শি‌থিল ক‌রেও অধ্যাত্ম প্রেরণালা‌ভের জন্য সাধুভ‌ক্তের সঙ্গ কর‌তেন । অশু‌দ্ধচিত্ত মানুষজ‌নের স্বভাবতই মীরার এই সাধুপ্রী‌তির অর্থ বোধগম্য হয়‌নি ।
মহারাজা বিক্রম‌জিৎ রাণা অতঃপর আ‌দেশ জা‌রি কর‌লেন, মীরা‌কে তার ঐ অ‌শোভন নৃত্য-গীত বন্ধ কর‌তে হবে এবং আ‌রো আপ‌ত্তিকর, তার ঐ সাধু‌দের স‌ঙ্গে মেলামেশা ত্যাগ কর‌তে হবে । তি‌নি না একজন নারী? তি‌নি না বিধবা? ত‌বে কেন তাঁর এই পুরুষ মানুষ‌দের সঙ্গলাভে ব্যাকুলতা? বিক্রম‌জিৎ সেই অপ‌াপা‌বিদ্ধা প‌বিত্রা নারীর বিরুদ্ধে কলঙ্ক রটনা কর‌তেও কিছুমাত্র বিচ‌লিত হ‌লেন না ।
রাজ-অন্তঃপু‌রে মীরা যখন এরূ‌পে সাধনভজ‌নে বাধাপ্রাপ্ত হ‌লেন, তি‌নি নিকটবর্তী এক দেবাল‌য়ে আশ্রয় গ্রহণ ক‌রে সেখা‌নেই তাঁর অ‌ভিরু‌চি অনুযায়ী সাধ‌নে মগ্ন হ‌লেন । তাঁর অভূতপূর্ণ দিব্য অনুরাগ ও প্রেম শীঘ্রই মানু‌ষের দৃ‌ষ্টি আকর্ষণ ক‌রল এবং ক্রমশই নিকট ও দূর-দূরান্তর হ‌তে দ‌লে দ‌লে ভক্তরা তাঁর নিকট আধ্যা‌ত্মিক অনু‌প্রেরণা লা‌ভের আশায় এ‌সে জমা‌য়েত হ‌তে থাকল । ফ‌লে মহারাণা ও পরিবারের অপরাপর লোকজ‌নের ক্রোধ উত্তরোত্তর বৃ‌দ্ধি পে‌তে থাকল । মীরা‌কে অতঃপর আক্ষ‌রিত অ‌র্থেই প্রাসা‌দের অভ্যন্তরে বন্দী করা হলো এবং তাঁর উপর এ‌কের পর এক নানাপ্রকার অমা‌নবিক নির্যাতন চল‌তে থাকল ।
মীরা নিছক এক ঈশ্বর‌প্রে‌মিক মাত্রই ছি‌লেন না, তি‌নি ক‌বিও ব‌টে । তাঁর কাব্য, যা তি‌নি ভজনাকার তাঁর গি‌রিধারীলা‌লের নিকট নি‌বেদন করতেন তা‌তে তাঁর প্র‌তি হওয়া নির্যাতন সম্প‌র্কে কিঞ্চিৎ আভাস মেলে । সে নির্যাতন কি অমানুষিক ছিল তা জেনে বিস্মিত হ‌তে হয়, কিন্তু মীরা কত সহ‌জে সে সকল সহ্য ক‌রে‌ছি‌লেন । এক‌টি ভজ‌নে মীরা গে‌য়ে‌ছেন তাঁর অভিজ্ঞতার কথা—

“মীরা সুখী তার প্রি‌য়ের পূজায় ।
ঝু‌ড়ি ভ‌রে সর্প আ‌সে মীরার তরে -
র‌াণার উপহ‌ার ।
ঝু‌ড়ি খু‌লে দে‌খে মীরা প্রভু স্বয়ং ।
রাণা পাঠান পেয়াল‌া ভরা বিষ ,
মীরা পান ক‌রে তা আকন্ঠ । 
বিষ হয় অমৃত , 
তাঁর (শ্রীকৃ‌ষ্ণের) ক‌ারসা‌জি‌তে ।
আ‌সে কন্টকশয্যা রাণার কাছ হতে ,
মীরা দে‌খে সে যে ফুল শয্যা ।
সকল বিপদ তুচ্ছ হয় 
গিরিধারীর সর্তক রক্ষ‌ণে । 
প্রেম মদিরায় মা‌তোয়ারা মীরা 
হাসে, নাচে, গায় প্রভুর নাম, 
উৎসর্গীকৃত সে যে 
  দ‌য়ি‌তের চর‌ণে ।”

ভক্তজীব‌ন অবলম্বন ক‌রে ভগবানের কৃপা ব‌হে শতধারে সহস্র বি‌চিত্র প‌থে । গান্ধী হত্যার সংবাদ শুনে বার্ণার্ড শ' আ‌র্তি প্রকাশ ক‌রে‌ছি‌লেন, “এই দু‌নিয়ায় ভাল মানুষ হবার এই তো ফল ৷” শ্রীরামচ‌ন্দ্রের ভক্ত ছি‌লেন গান্ধীজী । মাত্র কিছু‌দিন আ‌গেই এক প্রার্থন‌া সভায় বোমা বি‌স্ফো‌রণ হওয়া স‌ত্ত্বেও তিনি অক্ষত আ‌ছেন জে‌নে লো‌কে ব‌লে‌ছিল ‘রা‌খে হ‌রি মারে কে?’ কিন্তু তার অল্প‌দিন প‌রেই সেই শ্রীহরি তাঁ‌কে খুনীর বু‌লেট হ‌তে বাঁচা‌তে এ‌গি‌য়ে এ‌লেন না ।
পুরা‌ণে ক‌থিত বিষ্ণুর বালকভক্ত প্রহ্লাদকে হা‌তির পা‌য়ের নি‌চে ফে‌লে, পাহা‌ড়ের চূড়া হ‌তে ফে‌লে অথবা বিষ প্র‌য়োগা‌দি বি‌বিধ উপা‌য়েও মারা সম্ভব হয়‌নি । আবার সেই ঈশ্বর যীশু‌কে ক্রুশ‌বিদ্ধ বেশ নি‌র্বি‌ঘ্নেই ঘ‌টে‌ছিল । কিন্তু মীরার ক্ষে‌ত্রে গি‌রিধারীলাল তাঁ‌কে সর্ব‌তোভা‌বে রক্ষা ক‌রে যা‌চ্ছি‌লেন ।
ভগবা‌নের এক‌নিষ্ট ভক্ত‌দের জীব‌নের বি‌ভিন্ন ঘটনা আ‌লোচনা করে আমরা কখনো বা হতবু‌দ্ধি হ‌য়ে প‌ড়ি ।
আমা‌দের পক্ষে ঈশ্বর কৃপার প্রকৃত অর্থ সম্যক উপল‌ব্ধির প্রধান বাধা এই যে, আমরা স্থূলদৃ‌ষ্টি‌তে ভ‌ক্তি‌কে একপ্রক‌ার বি‌নি‌য়োগ ব‌লে বি‌বেচনা ক‌রি । আ‌মি ভগবা‌নকে ভ‌ক্তি ক‌রি; সুতরাং তাঁ‌কে হ‌তে হ‌বে একাধা‌রে আমার ব্য‌ক্তিগত পু‌লিশ, চি‌কিৎসক, উ‌কিল ইত্যা‌দি সব‌কিছু । অর্থাৎ তাঁ‌কে হতে হবে আমার আপৎকালীন লাইফ‌বোট । ভ‌ক্তির নগদ বিদায় হিসা‌বে পাওয়া চাই স্ব‌র্গের শিল‌মোহরা‌ঙ্কিত সুরক্ষা পত্র । ধর্ম‌ক্ষে‌ত্রে এরূপ ম‌নোভাব হ‌লো ব্যবসাদা‌রি, বা প্রশয় লাভের আগাম অঙ্গীকারপত্র গ্রহণ ক‌রে তার বি‌নিম‌য়ে বি‌বিধ অ‌বৈধ উপা‌য়ে ফল‌াও উপায়ে ফলাও কারবার করা !
গরল যখন অমৃত রূপান্ত‌রিত হয় তখন সত্যতা বজায় থা‌কে, আবার যখন বিষ স‌ক্রিয় হয় তখনও । যারা সৎকর্ম কর‌তে ব্রতী হ‌য়ে তার শুভাশুভ কর্মফল শান্ত‌চিত্তে গ্রহণ কর‌তে প্রস্তুত থাকে, ভগবানের কৃপা তাদের উপরই ব‌র্ষিত হয় । মীরা বিষ অমৃ‌তে প‌রিণত হ‌বেই এমন‌টি আশা ক‌রে তা গ্রহণ ক‌রে‌ছি‌লেন এমন নয়, তি‌নি তা গ্রহণ ক‌রে‌ছি‌লেন পরম প্রেমাষ্পদের প্রের‌তি প্রসাদ জ্ঞানে । কৃপার সত্যতা প্রমা‌ণিত হয় ভগবান প্রদত্ত সেই শ‌ক্তির আ‌বির্ভাব চাক্ষুষ ক‌রে, যার ব‌লে ভক্ত যে কোন ফ‌লের জন্য সদা প্রস্তুত থা‌কে, নিঃশঙ্ক থা‌কে ।
মহা‌যোগী পত্তহারী বাবা‌কে যখন সর্প দংশন ক‌রে‌ছিল, তি‌নি ব‌লে‌ছি‌লেন, “প্রভুর নিকট হ‌তে দূত প্রে‌রিত হ‌য়ে‌ছে । " ভাল-মন্দ, আনন্দ-বেদনা, আনুকূল্য-প্র‌তিকূলতা, জন্ম-মৃত্যু প্রভৃ‌তি সকলই সেই পরম‌প্রি‌য়ের নিকট হ‌তে প্রে‌রিত বার্তা । যখন আমরা এই দ্বন্ধমূলক বিষয়সমূহ গ্রহণীয় অথবা বর্জনীয় রূ‌পে না দে‌খে তা‌দের ঈশ্বর প্রেরিত প্রেম প্রসাদ ব‌লে গ্রহণ কর‌তে শি‌খি, তখনই যথার্থ ভ‌ক্তির উদয় হ‌য়ে‌ছে বলা য‌ায় ।
ঈশ্বর কৃপার প্রমাণ অনুকূল অথবা প্র‌তিকূল ঘটনার উপর নির্ভরশীল নয়, তার প্রমাণ আত্মশ‌ক্তির প‌রিচ‌য়ে, যা ঈশ্ব‌রের দান মাত্র । সেই দেবদত্ত শ‌ক্তি ব‌লে আনন্দ অথব‌া দুঃখ যাই আসুক না কেন, হা‌সিমু‌খে গ্রহণ করা সম্ভব হয় । ঈশ্বর সকল সম‌য়ে পরীক্ষা নেন আমাদের থে‌কে । যখন সু‌খে থা‌কি তখন ভু‌লে যায়, যখন দুঃখী হই তখন ম‌নে প‌ড়ে । কারণ ঈশ্বর‌কে ভু‌লে থাকার কার‌ণে কত কিছুর সম্মুখীন হ‌তে হয় ।




কৃষ্ণপ্রিয়া মীরা : পর্ব- ১


=======================

শৈশব ও প্রার‌ম্ভিক জীবন

=======================

ভারতব‌র্ষের ই‌তিহা‌সে মহাসা‌ধিকা মীরাবাঈ‌য়ের জীবন ঈশ্ব‌রের প্র‌তি সর্বগ্রাসী প্রে‌মের এক অত্যুজ্জ্বল দৃষ্টান্ত । মীরাবাঈ‌য়ের নাম স্মরণমাত্র ভক্তহৃদ‌য়ে ভ‌ক্তির প্রেরণা জাগায় ৷ মীরার জীব‌নে ভারতবর্ষ দে‌খে‌ছিল কৃ‌ষ্ণের প্র‌তি গোপী‌প্রে‌মের পুনরা‌বির্ভাব, যা তার মহান আধ্যা‌ত্মিক ধারা‌টি‌তে নব প্রাণ সঞ্চার করতে সাহায্য ক‌রে‌ছিল ।
ভারতব‌র্ষে লক্ষ লক্ষ মানু‌ষের ক‌ন্ঠে, দেবাল‌য়, ম‌ঠে, আখড়ায়, অসংখ্য পথ-চল‌তি পান্থ‌নিবা‌সে, এমন‌কি চল‌চ্চি‌ত্রে যদিও মীরার ভজন নিত্য‌দিন গীত হ‌য়ে চ‌লে‌ছে, তাঁর কোন প্রামা‌ণিক জীবন কিন্তু এখ‌নো পাওয়া যায়‌নি । অবশ্য অনুসন্ধান কার্য চল‌ছে । এখ‌া‌নে আমরা বি‌ভিন্ন কার‌ণে অ‌ধিকতর গ্রহণ‌যোগ্য ব‌লে ম‌নে হয় এমন এক‌টি জীবনীর অনুসরণ করব ।
১৫০৪ খ্রীষ্টা‌ব্দে রাজস্থা‌নের অন্তর্গত কুড়কী গ্রা‌মে, ক্ষত্রিয় বং‌শে, রতন সিং এর কন্যারূ‌পে মীরার জন্ম । রাজস্থা‌নের অবস্থান ভারতব‌র্ষের মধ্য-প‌শ্চিম অঞ্চ‌লে । ভারত ই‌তিহা‌সের বহু শৌর্যপূর্ণ কা‌হিনী রাজস্থা‌নের অ‌ধিবাসী বীর রাজপুত রমণী‌দের কেন্দ্র ক‌রে প্রচা‌রিত । ঊষর মরু প্র‌দে‌শে যোদ্ধাজা‌তির ম‌ধ্যে মীরার আবির্ভা‌বে অ‌ভিনবত্ব আ‌ছে । তি‌নিও বীর, ত‌বে যুদ্ধ‌ক্ষে‌ত্রে নয়, বীর রমণী তি‌নি ভ‌ক্তি‌তে, ভগবা‌নের চর‌ণে আত্ম‌নি‌বেদ‌নে ।
মাত্র তিন বৎসর বয়‌সে মীরা অ‌ধিকার ক‌রে‌ছিল তার জীব‌নের প্র‌তিমা‌টি‌কে, য‌া‌কে জগ‌তের কোন শ‌ক্তিই তার নিকট হ‌তে বি‌চ্ছিন্ন কর‌তে সমর্থ হয়‌নি । এক‌দিন এক সাধুভক্ত তাঁর পিত্রাল‌য়ে রা‌তের অ‌তি‌থিরূ‌পে আশ্রয় নি‌য়ে‌ছি‌লেন । তাঁর স‌ঙ্গে ছিল এক শ্রীকৃষ্ণমূ‌র্তি, গি‌রিধর গোপাল, যাঁ‌কে তি‌নি নিত্য পূজা কর‌তেন । রন সিং এর গৃ‌হে থাকাকা‌লে যখন এক‌দিন সাধু‌টি তাঁর ইষ্ট‌দেবতা গি‌রিধ‌রের পূজা কর‌ছেন, ছোট্ট মীরা উক্ত মূ‌র্তি‌টির প্র‌তি এক অপ্রতি‌রোধ্য আকর্ষণ অনুভব করল এবং তাঁ‌কে একান্ত নি‌জের ক‌রে পে‌তে চাইল ।
কিন্তু সাধুজী তাঁর উপাস্য দেবতা, যাঁ‌কে দীর্ঘকাল যাবৎ পূজা করে আস‌ছেন, হাতছাড়া কর‌তে রা‌জি নন । মীরা অনশন করার উপক্রম করল । ছোট শিশুর ভালবাসার প্রচণ্ড দা‌বি হৃদয় স্পর্শ না ক‌রে পা‌রে না । কিন্তু বাবাজীও তাঁর প্রা‌ণের দেবতা ‘গি‌রিধারী‌লাল’ ছাড়া অপর সব কিছুই দি‌তে প্রস্তুত । প্রে‌মের এই দ্ব‌ন্বে অব‌শে‌ষে মীরারই জয় হ‌লো । স্বয়ং ‘গি‌রিধারীলাল’ সাধুজী‌কে স্ব‌প্নের মাধ্যমে মীর‌ার কা‌ছে থাকার ইচ্ছা প্রকাশ কর‌লেন । সুতরাং অব‌শে‌ষে ব্য‌থিত হৃদ‌য়ে তাঁর দেবতা‌কে শেষবা‌রের ম‌তো নি‌মেষভা‌বে দর্শন ক‌রে সাধুজী ক‌ম্পিত হ‌স্তে গি‌রিধারীলালকে মীরার হা‌তে তু‌লে দি‌লেন । সজল চ‌ক্ষে তি‌নি ভগবানের অবোধ্য লীলার কথা ভাব‌তে ভা‌ব‌তে জনার‌ণ্যে অন্ত‌র্হিত হ‌লেন ।
শ্রীরামকৃ‌ষ্ণের জীবনী পাঠকরাও অবগত আ‌ছেন,‌ কেমন ক‌রে ঠিক অনুরূ‌পভা‌বে জটাধারী না‌মে এক বৈষ্ণব সাধু দ‌ক্ষি‌ণেশ্ব‌রে কিছু‌দি‌নের জন্য এ‌সে, তাঁর প্রিয় ‘রামলালা’ মূ‌র্তিখা‌নি শ্র‌ীরামকৃ‌ষ্ণের নিকট অর্পণ ক‌রে চ‌লে গে‌ছি‌লেন । তখনো জটাধারী‌কে ‘রামলালা’ স্ব‌প্নে দেখা দি‌য়ে শ্রীরামকৃ‌ষ্ণের নিকট থাকার আকা‌ঙ্ক্ষা প্রকাশ ক‌রে‌ছি‌লেন ।
ভক্ত ও ভগবা‌নের ম‌ধ্যে এই রহস্যপূর্ণ ভাব বি‌নিম‌য়ের অর্থ আমা‌দের প্রাকৃত জ‌নের বু‌দ্ধির অগম্য । কিন্তু তাই ব‌লে আমা‌দের ক্ষুদ্রবু‌দ্ধির উপর যেন অ‌ধিক আস্থা না রা‌খি এবং যা বু‌দ্ধির অগম্য, এমন ঘটনাসমূহ তুচ্ছজ্ঞা‌নে বা‌তিল না ক‌রে দিই । আধ্যাত্মিক অনুভূ‌তির অ‌ধিকাংশ ঘটনাই ঘ‌টে যু‌ক্তি-বু‌দ্ধির সীমানা ছা‌ড়ি‌য়ে । প্রে‌মের সেই দ্বন্ধযু‌দ্ধে জয়ী হয়ে মীরা যে কত আনন্দিত হ‌য়ে‌ছিল তা সহ‌জেই অনু‌মেয় । কিন্তু সেই গি‌রিধর মূর্তির মীরার বিরহ ও আন‌ন্দের কেন্দ্র হ‌য়ে ওঠার ব্যাপার‌টি কল্পনা করা আমাদের দুঃসাধ্য ৷
শিশুরা স্বভাবতই খুব চতুর । তারা জা‌নে কেমন ক‌রে বাবা-মা‌য়ের কাছ হ‌তে ঠোঁট ফু‌লি‌য়ে বায়না ক‌রে খেলনা আদায় কর‌তে হয় । এ‌ক্ষে‌ত্রে মীরা কিন্তু ছিল অস্বাভা‌বিক রকম জেদী ও আগ্রাসী । সে যা অধিকার করল তা, যেমন শিশুরা আগ্রহ ফু‌রি‌য়ে গে‌লে খেলনা ছুঁ‌ড়ে ফে‌লে দেয়, তেমন ক‌রে ত্যাগ করল না ৷
এই ঘটনার পর এক‌দিন বা‌ড়ির সাম‌নে দি‌য়ে যখন এক বিবাহ মি‌ছিল যাচ্ছে, মীরা তার মা‌কে জিজ্ঞাসা করল, “মা আমার দুল্-হা কোথায়?” ‘দুল্-হা’ অ‌র্থে বর অথবা প্রেমাস্পদও হয় ৷ শিশুর সরল ছে‌লেমানুষী দে‌খে মা হে‌সে গি‌রিধারীর মূ‌র্তির প্র‌তি অঙ্গু‌লি নি‌র্দেশ ক‌রে মীরা‌কে ব‌লে‌ছি‌লেন, “গি‌রিধারীলাল গোপালই তোমার দুল্-হা ৷” তি‌নি যখন একথা ব‌লে‌ছি‌লেন, তাঁর নিশ্চয় মীরার দেখা সেই স্বপ্নদৃ‌শ্যের কথা ম‌নে প‌ড়ে‌ছিল, যা মীরা তাঁ‌কে এক‌দিন ব‌লে‌ছিল । স্ব‌প্নে মীরা দে‌খে‌ছিল শ্রীকৃ‌ষ্ণের স‌ঙ্গে তার বিবাহ হ‌চ্ছে ।
যাই‌হোক, মা‌য়ের সেই কথা মীরা যে কত সত্য ব‌লে গ্রহণ ক‌রে‌ছিল তা আত্মীয় স্ব‌জনের বি‌স্মিত দৃ‌ষ্টির সম্মু‌খে তার বয়স বাড়ার স‌ঙ্গে স‌ঙ্গে ক্রমশই প্রকাশ হ‌তে থাকল । অন্ত‌রের ভাষা মীরা তাঁর র‌চিত ভজ‌নে চিরা‌য়িত ক‌রে রে‌খে‌ছেন—
‘মে‌রে তো গি‌রিধারী গোপাল দুসরা না কোঈ ।
যা‌কে শির মোর মুকুট মে‌রে প‌তি সোঈ . . . . ।’
অর্থাৎ আমার প্রভু গি‌রিধারী গোপাল ছাড়া আর তো কেউ নয়। যাঁর শি‌রে ময়ূর মুকট তিনিই যে আমার প‌তি।
আটবছর বয়‌সে মীরা মা‌কে হা‌রি‌য়ে তার ‘দুদাজী'র কা‌ছে চলে এল । তি‌নি ছি‌লেন পরম বৈষ্ণব ভক্ত । ঠাকুর্দার কো‌লে ব‌সে মীরা তন্ময় হ‌য়ে শুনত মহাভারত প্রভৃ‌তি পৌরা‌ণিক কা‌হিনী । মীরা কিন্তু ম‌নে ম‌নে সর্বদাই জা‌নে গি‌রিধারী গোপা‌লের স‌ঙ্গেই তার বিবাহ হ‌য়ে‌ছে । কিন্তু অপর কেউই সে ব্যাপা‌রে গুরুত্ব দেয়‌নি । ১৫১৬ খ্রীষ্টা‌ব্দে যখন মীরা ১৩ বছ‌রে পা দি‌ল, তার বাবা মেবা‌রের মহারাণা সংগ্রাম সিং‌হের পুত্র যুবরাজ ভোজরা‌জের স‌ঙ্গে মীরার বিবাহ দি‌লেন ।
শ্বশুরাল‌য়ে এ‌সে মীরা নিত্যই তার নতুন আত্মীয় প‌রিজন‌দের হতাশ কর‌তে লাগ‌লেন ৷ কুলপ্রথা হিসা‌বে নববধূ‌কে যখন রাজপ‌রিবা‌রের দেবী ম‌ন্দি‌রে নি‌য়ে যাওয়া হ‌লো, মীরা জানা‌লেন, তিতি গি‌রিধারী কৃষ্ণ ছাড়া অপর কাউ‌কে প্রণাম নি‌বেদন কর‌বেন না । সদ্যনতুন আত্মীয়দের নিকট মীরার এই অবাধ্যতার অর্থ বোধগম্য হ‌লো না । তি‌নি কি উন্মাদ অথবা ধর্মাদ্ধ ? রাজপ‌রিবা‌রের নিকট তি‌নি শ্রদ্ধাহীন ও উদ্ধত ব‌লে প্র‌তিভাত হ‌লেন ।
মীরার ন্যায় সা‌ধিকার মন সাধারণভা‌বে কাজ ক‌রে না । তি‌নি এমন এক‌টি প‌রি‌স্থি‌তির সম্মুখীন হ‌য়ে‌ছি‌লেন যখন, এক‌টি অনাবশ্যক ও অবাস্তব বিবাহ অনুষ্ঠান দ্বারা এক পরম বাস্ত‌বে দিব্য বিবাহ ব্যাপার‌কে সম্পূর্ণ বা‌তিল করার প্রয়াস হ‌চ্ছিল, সেই পুরু‌ষের প্র‌তি কোন অনুরাগ বা তাঁ‌কে প্র‌য়োজন এমন বোধ তাঁর হ‌চ্ছিল না । তি‌নি যে ই‌তিমধ্যেই তাঁর স্বামী, তাঁর সর্বস্ব গি‌রিধারী গোপাল‌কে তনু-মন-প্রাণ সমর্পণ ক‌রে দি‌য়ে‌ছেন । ঠিক এমনই মান‌সিকতার আ‌বে‌গে তি‌নি অপর দেবতার প্র‌তি ভ‌ক্তি প্রদর্শন করা‌কে দ্বিচারিণীর কর্ম ব‌লে ম‌নে ক‌রে‌ছি‌লেন । যে হৃদয়‌টি‌কে একজনের প্র‌তি নি‌বেদন ক‌রেই দি‌য়ে‌ছেন, তা কেমন ক‌রে পুনরায় অপর দেবতার প্র‌তি নি‌বেদন কর‌বেন ? তা কি কপটতা নয় ?
মীরার শ্বশুলা‌য়ের কুটুম্ব‌দের আশাভ‌ঙ্গের আ‌রো কা‌রণ,‌ তি‌নি যুবতী কন্যাসুলভ কোন ভোগবাসনায় উৎসাহ প্রকাশ ক‌রেন‌নি । রাজপুত সমা‌জে র‌জোগু‌ণের বি‌শেষ সমাদর, সেখা‌নে নারী দৈ‌হিক ও মান‌সিক ভোগ্যবস্তু ব‌লেই সর্বজনস্বীকৃত । কিন্তু মীরা সম্পূর্ণ অন্য প্রকৃ‌তির নারী । বিবা‌হের পর মীরার অ‌ধিকাংশ সময় ব্য‌য়িত হ‌তো পূজাগৃ‌হে গি‌রিধ‌রের সেবা-পূজা ও ভজন কীর্ত‌নে । অ‌ধিকন্তু তি‌নি সাধু-ভক্ত-জ্ঞানী‌দের নিমন্ত্রণ ক‌রে ধর্মসভার আসর ব‌সি‌য়ে নিয়ত তাঁ‌দের স‌ঙ্গে ধর্মচর্চা কর‌তে লাগ‌লেন । বলাবাহুল্য, তাঁর এরূপ জীবনধারার কোন‌টিই, রাজপ‌রিবারের পছন্দ হ‌লো না ।
মীরা‌কে আ‌দেশ দেওয়া হ‌লো, তি‌নি যেন এ সকল ত্যাগ ক‌রে রাজপ‌রিবা‌রের ঐ‌তিহ্য মে‌নে চ‌লেন, কিন্তু তা‌তে ফল হ‌লো না । তাঁর অন্ত‌রে আধ্যা‌ত্মিক তৃষ্ণা এতই তীব্র, সাধারণ গৃহীসুলভ জীবন যাপন করা তাঁর পক্ষে একান্তই অসম্ভব । সুতরাং তাঁর উপর ক‌ঠোর নি‌ষেধাজ্ঞা জা‌রি হলো । মীরা তাঁর স্বভাবসুলভ ভ‌ঙ্গি‌তে ভজ‌নের মাধ্য‌মে প্রকাশ কর‌লেন তাঁর প্র‌তি‌ক্রিয়া । এক‌টি গা‌নে তি‌নি গাই‌ছেন, ‘‘এ রাজপুরীর সকল প‌রিজন আমার সাধুসঙ্গ প্রিয়তার কার‌ণে আমা‌কে দি‌চ্ছে যন্ত্রণা, আমার পূজায় ঘটা‌চ্ছে বিঘ্ন । গি‌রিধর নাগর মীরার সখ্য ও প্রিয়তম, তার সে অনুরাগ তো ঘোচার নয়, তা যে উত্ত‌রোত্তর বাড়তেই থা‌কবে ।”




বুধবার, ১৮ অক্টোবর, ২০১৭

বৈষ্ণবাচার্য শ্রীরামানুজের জীবনাদর্শ

রামানুজাচার্য ডাকটিকিট প্রকাশঅনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদীর ভাষণ

মহান সমাজ সংস্কারক ও সন্ত শ্রী রামানুজাচার্যের সহস্রতম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করতে পেরে আমি অত্যন্ত আনন্দিত। আমাকে এই সুযোগ দেওয়ায় আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করছি।
সন্ত শ্রী রামানুজাচার্যের জীবনের মূল বার্তা হ’ল সকলকে সামিল করে সমাজ, ধর্ম ও দর্শন। সন্ত শ্রী রামানুজাচার্য বিশ্বাস করতেন, যাই হোক আর যা হবে তা সবই ভগবানের প্রকাশ। তিনি মানবদেহে ঈশ্বরের প্রকাশ আর ঈশ্বরের মধ্যে মানবত্বকে দর্শন করেছিলেন। ঈশ্বরের সব ভক্তই তাঁর চোখে ছিলেন সমান।
যখন জাতিভেদ এবং বর্ণাশ্রম প্রথা সমাজ ও ধর্মের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ বলে মনেকরা হ’ত আর প্রত্যেকেই ঐ বর্ণাশ্রমের উচ্চ-নীচ অনুযায়ী সমাজে নিজের স্থানটি উঁচুতে বা নীচুতে যাই হোক না কেন তা মেনে নিত, সন্ত শ্রী রামানুজাচার্য এর বিরুদ্ধেবিদ্রোহ করেছিলেন – তাঁর নিজের জীবনে আর ধর্মীয় শিক্ষাদানের মধ্য দিয়ে।
সন্ত শ্রী রামানুজাচার্য কেবল উপদেশই দেননি, কেবল নতুন পথ দেখাননি, নিজের বাণীগুলি তিনি নিজের জীবনে পালনও করেছেন। আমাদের শাস্ত্রে লেখা রয়েছে – ‘মনসাওয়াচা কর্মনা’ – এই সূত্র অনুসরণ করে তিনি নিজের জীবনটাকেই নিজের উপদেশে পরিণত করেছেন। যা তাঁর মনে ছিল, তাই বাণীতে লিপিবদ্ধ করেছেন, তাই বাস্তবে পালন করে দেখিয়েছেন। সন্ত শ্রী রামানুজাচার্যের বিশেষত্ব ছিল যে, যখনই কোনও বিবাদ হ’ত, তিনি পরিস্থিতিকে আরও বিগড়ে যাওয়া থেকে আটকানো আর সমস্যার সমাধান করতে চেষ্টা করতেন। ঈশ্বরকে বোঝার জন্য অদ্বৈতবাদ ও দ্বৈতবাদ থেকে ভিন্ন মধ্যবর্তী একটি পথ ‘বিশিষ্টাদ্বৈত’ ও তেমনই একটি প্রচেষ্টা।
সমাজে বৈষম্য সৃষ্টিকারী যে কোনও পরম্পরার বিরোধী ছিলেন তিনি। সেই ব্যবস্থাকে ভাঙার জন্য, বদলানোর জন্য সম্পূর্ণ শক্তি দিয়ে চেষ্টা করতেন।
আপনারা হয়তো জানেন যে, কিভাবে মুক্তি আর মোক্ষের যে মন্ত্রটি তাঁকে সার্বজনিক করতে মানা করা হয়েছিল, তিনি একটি সভা ডেকে সমাজের প্রত্যেকবর্গ, প্রত্যেক স্তরের মানুষের সামনে তা পাঠ করে শুনিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, যে মন্ত্রে মানুষ সমস্যাগুলি থেকে মুক্তি পায়, তা কোনও একজনের কাছে কেন থাকবে, প্রত্যেক গরিব ব্যক্তিরও তা জানা উচিৎ। সন্ত শ্রী রামানুজাচার্যের হৃদয় এত বিশাল, এত পরোপকারী ছিলেন!
দরিদ্রদের জন্য, শোষিত, বঞ্চিত, দলিতদের জন্য তিনি সাক্ষাৎ ভগবানের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। একটা সময়ে তিরুচিরাপল্লীর শ্রী রঙ্গম মন্দির-এর সম্পূর্ণ প্রশাসন একটি বিশেষ জাতির কুক্ষিগত ছিল। শ্রী রামানুজাচার্য মন্দিরের প্রশাসনিক প্রক্রিয়াই বদলে দেন। তিনি নানা জাতির প্রতিনিধিদের প্রশাসনে সামিল করেন।মহিলাদেরকেও বেশ কিছু দায়িত্ব অর্পণ করেন। মন্দিরকে তিনি নাগরিক কল্যাণ ও জনসেবার কেন্দ্র করে তোলেন। এমন প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করেন যেখানে গরিবদের আহার, ওষুধ, জামাকাপড় এবং থাকার জায়গা দেওয়া হ’ত । তাঁর সেই সংস্কারমূলক আদর্শ আজও বেশ কয়েকটি মন্দিরে ‘রামানুজ-কুট’ রূপে দেখা যায়।
ঠিক এই কারণেই স্বামী বিবেকানন্দ সন্ত শ্রী রামানুজাচার্যের হৃদয় সম্পর্কে বলেছিলেন। সেই বিশাল হৃদয়, যা নীচে শ্রেণীর জন্য কাঁদতো এমন এক যুগে যখন নীচু শ্রেণীতে জন্মানোটা ব্যক্তিবিশেষের কর্মের অঙ্গ বলে স্বীকার করা ও মেনে নেওয়া হ’ত। সন্ত শ্রী রামানুজাচার্য তাঁর সময়ের সর্বমান্য সংস্কার ভেঙে দিয়েছিলেন। তাঁর চিন্তাভাবনা সেই যুগের তুলনায় অনেক এগিয়ে ছিল।
একাধিক দিক থেকে সন্ত শ্রী রামানুজাচার্য ছিলেন, শতাব্দীপারের সন্ন্যাসী –যিনি এক হাজার বছর আগেই দেখেছিলেন, নিম্ন শ্রেণীর না বলা ও সুপ্ত আকাঙ্খার কথা আগেই জেনে গিয়েছিলেন। সামাজিকভাবে অন্ত্যজ, বেজাত ও দিব্যাঙ্গদের সামিল করার প্রয়োজন তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, শুধু ধর্মই নয়, সমাজকেও পূর্ণ করে তুলতে ।
তাঁর জীবন থেকে এমনই অনেক উদাহরণ পাওয়া যায়। বর্ণাশ্রমকে তুড়ি মেরে তিনি এমনকি নিম্নবর্ণের এক প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিকে নিজের গুরু হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন, যা তখনকার সমাজে ছিল একটি অভাবনীয়, অকল্পনীয় ঘটনা। তিনি আদিবাসীদের সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির কাজে আত্মনিয়োজিত হয়ে তাঁদের সামাজিক জীবনেও সংস্কারমূলক কাজ করেন।
সেজন্য তৎকালীন সময়ে প্রত্যেক ধর্মের প্রতিটি বর্গের মানুষ শ্রীরামানুজাচার্যের উপস্থিতি ও বাণী থেকে প্রেরণা পেতেন। মেল্কোটের মন্দিরে ভগবানের আরাধনারতা মুসলিম রাজকন্যা বিবি নচিয়ারের মূর্তি এর প্রমাণ। দেশের খুব কম মানুষ হয়তো জানেন, আজ থেকে হাজার বছর আগে সন্ত রামানুজাচার্য মন্দিরে দিল্লির সুলতানের কন্যা বিবি নচিয়ারের মূর্তি স্থাপন করিয়েছিলেন।
আপনারা কল্পনা করতে পারেন যে এভাবে তৎকালীন সামাজিক প্রেক্ষিতে ধর্মীয়সদ্ভাবের কত বড় বার্তা সন্ত শ্রী রামানুজাচার্য এই কাজের মাধ্যমে দিয়েছিলেন। আজও ভক্তরা সমানভাবে বিবি নচিয়ারের মূর্তিকে শ্রদ্ধাঞ্জলি প্রদান করেন। আজও সন্ত রামানুজাচার্যের বার্তা সম্পূর্ণ প্রাসঙ্গিক।
সন্ত শ্রী রামানুজাচার্যের জীবন এবং শিক্ষায় ভারতীয় সমাজের উদার, বহুত্ববাদী এবং সহিষ্ণু স্বরূপ আরও মজবুত হয়েছিল। বাবাসাহেব ভীমরা ও আম্বেদকরও তাঁর সম্পর্কে নিজের সাহিত্যপত্র ‘বহিষ্কৃত ভারত’-এর ৩ জুন, ১৯২৭ সংখ্যায় একটি সম্পাদকীয় লিখেছিলেন। আজ থেকে ৯০ বছর আগে লেখা সেই সম্পাদকীয়টি পাঠ করলে সন্ত শ্রীরামানুজাচার্যের প্রেরণাময়ী জীবনের কত কথা মনমন্দিরকে স্পর্শ করে যায়!
বাবাসাহেব লিখেছিলেন, “হিন্দু ধর্মে সাম্যের লক্ষ্যে কেউ যদি গুরুত্বপূর্ণকাজ করে থাকেন, আর তাঁর চিন্তাভাবনাকে বাস্তবে প্রয়োগ করে থাকেন, তিনি হলেন শ্রীরামানুজাচার্য। তিনি কাঞ্চীপূর্ণ নামক একজন অব্রাহ্মণকে নিজের গুরুর স্থান দিয়েছিলেন। গুরুকে ভোজন করানোর পর শ্রী রামানুজাচার্যের স্ত্রী ঘরকে শুদ্ধ করারচেষ্টা করলে তিনি তার বিরোধিতা করেন”।
একজন দলিত গুরুর ভোজনের পর নিজের বাড়িতেই শুদ্ধ করার প্রয়াস তাঁকে দুঃখ দেয়, তিনি রেগেও যান। যে কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তাঁর লড়াই সেই কুরীতিগুলি আগে নিজেরবাড়ি থেকে দূর করার চেষ্টা করেন। তারপরই তিনি সন্ন্যাস গ্রহণ করে নিজের বাকি জীবন সমাজহিতে সমর্পণ করেন। আমি আবার বলছি, তিনি শুধুমাত্র উপদেশ দিয়েই ক্ষান্ত হননি, নিজের কর্মের মাধ্যমে সেই উপদেশগুলি নিজেও অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন।
তৎকালীন সময়ে নারী ক্ষ্মতায়নের ক্ষেত্রে রামানুজাচার্য কিভাবে কাজ করেছিলেন, তাও বাবাসাহেব তাঁর সম্পাদকীয়তে উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন –“তিরুবল্লীতে এক মহিলার সঙ্গে শাস্ত্র নিয়ে আলোচনার পর তিনি সেই মহিলাকে বলেছিলেন যে, আপনি অনেক বিষয়ে আমার থেকে বেশি জানেন! তারপর সন্ত শ্রী রামানুজাচার্য সেই মহিলাকে দীক্ষা দেন এবং পরবর্তীকালে তাঁর মর্মর মূর্তিও মন্দিরে স্থাপন করেন। তিনি ধনুর্দাস নামক এক অস্পৃশ্য ব্যক্তিকেও দীক্ষা দিয়েছিলেন। সেই শিষ্যের সাহায্য নিয়ে তিনি নদী থেকে স্নান করে মন্দিরে ফিরতেন”।
বিনম্রতা এবং বিদ্রোহী প্রবৃত্তির অদ্ভূত মিশ্রণ ছিল তাঁর স্বভাবে। সেজন্যবাবাসাহেব সন্ত রামানুজাচার্যের ভাবাদর্শ দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। যাঁরা বাবাসাহেবের লেখাগুলি পড়েছেন, তাঁরা হয়তো লক্ষ্য করেছেন, তাঁর জীবন ও ভাবনা-চিন্তায় সন্ত রামানুজাচার্যের কত প্রভাব ছিল।
আমার মনে হয়, সারা পৃথিবীতে এরকম মহাপুরুষ বিরল যাঁদের জীবন ও ভাবাদর্শ একহাজার বছর ধরে নানা কালখন্ডে মানুষ এমন প্রেরণা নিতে পেরেছেন। সন্ত শ্রীরামানুজাচার্যের ভাবধারায় প্রভাবিত হয়ে গত এক হাজার বছরে বেশ কয়েকটি সামাজিক আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। তাঁর সরল বার্তাগুলিই নানা সময়ে দেশের নানা প্রান্তে ভক্তি আন্দোলনের স্বরূপ নির্ধারণ করে।
মহারাষ্ট্রের ওয়ারকরী সম্প্রদায়, রাজস্থান এবং গুজরাটের বল্লভ সম্প্রদায়, মধ্য ভারত এবং বাংলায় চৈতন্য সম্প্রদায় এবং আসামে শঙ্করদেব তাঁর ভাবধারাকে অসংখ্য মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন।
সন্ত শ্রী রামানুজাচার্যের বাণী দ্বারা প্রভাবিত হয়ে গুজরাটের আদি কবি সন্ত নরসী মেহতা বলেছিলেন, ‘বৈষ্ণব জন তো তেনে কহিয়ে, জে পীর পরাই জানে রে’! গরিবের দরদবোঝার এই ভাব সন্ত শ্রী রামানুজাচার্যেরই অবদান।
এই এক হাজার বছর ধরে সন্ত শ্রী রামানুজাচার্যের বাণীগুলি দেশের লক্ষ কোটি মানুষকে সামাজিক সাম্য, সদ্ভাব আর সামাজিক দায়িত্ব পালনের শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছে।তিনি কট্টরতা আর পূজোর আচার ব্যবহারে ডুবে থাকেই ধর্ম মনে করাকে অজ্ঞান, কাপুরুষ, অন্ধবিশ্বাস ও যুক্তিহীনতার পথ বলে মনে করেন। সেজন্য যখনই কেউ জাতিভেদ, বৈষম্য আর হিংসার বিরুদ্ধে উঠে দাঁড়ান তিনি গুরু নানক কিম্বা সন্ত কবীর দাসের মতো প্রাতঃস্মরণীয় মহাপুরুষ হয়ে ওঠেন।
সময়ের কষ্টিপাথরে যা কিছু টেকে না, তা যত প্রাচীনই হোক না কেন, সংস্কারের মাধ্যমে তাকে সময়োপযোগী করে তোলাই ভারতীয় সংস্কৃতির মূল চরিত্র। সেজন্য যুগে যুগে আমাদের দেশে এহেন মহাপুরুষেরা আবির্ভূত হয়েছেন, যাঁরা নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থক্ষুন্ন করে, বিষ পান করে নীলকন্ঠ হয়ে উঠে সকল প্রকার ঝুঁকি উঠিয়ে সমাজ সংস্কারের কাজ করেছেন। তাঁরাই হাজার হাজার বছর পুরনো ব্যবস্থার গ্লানি ও কুসংস্কারগুলি বিনাশ করে পুনর্নবীকৃত করেছেন। তাঁরা সমাজ পরিবর্তনের স্বার্থে ভারতাত্মাকে রক্ষা করা ও তাকে জাগ্রত করার জন্য কাজ করেছেন।
সন্ত শ্রী রামানুজাচার্যের মতো ঋষিদের তপস্যা তাঁদের সৃষ্ট এবং অবিরাম চলতে থাকা সামাজিক জাগরণের পুণ্য প্রবাহের প্রতাপ হ’ল – আমাদের শ্রদ্ধা সর্বদা আমাদের গৌরবময় ইতিহাসে অবিকৃত থেকেছে আমাদের আচরণ, রীতি-রেওয়াজ ও ঐতিহ্যগুলি সময়োপযোগি হয়ে উঠেছে। সেজন্য আমাদের সমাজ যুগে যুগে সর্বদাই উর্ধ্বগামী হতে পেরেছে। এই সেই অমরত্ব, যার দ্বারা আমাদের সংস্কৃতি চিরপুরাতন হয়েও নিত্যনতুন হয়ে থেকেছে। এই পুণ্যাত্মা মহাপুরুষদের অমৃত মন্থনের ফলেই আমরা গর্ব করে বলতে পারি যে, “কুছ বাত হ্যায় কি হস্তী মিটতী নহীঁ হমারী, সদিয়োঁ রাহা হ্যায় দুষ্মন দৌড়ে – জমাঁ হমারা”। বিশ্বের মানচিত্র বদলে গেছে, বড় বড় দেশ ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে কিন্তু আমাদের ভারত, আমাদের হিন্দুস্থান সবার সাথে সবার বিকাশ মন্ত্র সম্বল করে এগিয়ে চলেছে।
আজ আমি অত্যন্ত আনন্দিত যে, সন্ত শ্রী রামানুজাচার্যের জন্ম সহস্রাব্দীবর্ষে অনেক সংস্থা একত্রে তাঁর শিক্ষা এবং বার্তাগুলিকে ঘরে ঘরে পৌঁছে দিচ্ছেন। আমি আশা করব যে, এই শিক্ষা এবং বার্তার মাধ্যমে দেশের বর্তমানকে যুক্ত করা সম্ভব হচ্ছে।
আপনারা সকলেই জানেন যে, সন্ত শ্রী রামানুজাচার্য গরিবের চাহিদা পূরণের সঙ্গে সামাজিক দায়িত্ববোধকে যুক্ত করেছিলেন। উদাহরণস্বরূপ, তিনি মেলকোটের কাছে থোন্ডানুরে ২০০ একর জায়গা জুড়ে একটি কৃত্রিম সরোবর তৈরি করিয়েছিলেন। এই সরোবরটি মানব কল্যাণে সন্ত শ্রী রামানুজাচার্যের সুকর্মের জীবন্ত দৃষ্টান্ত হয়ে আজও বিদ্যমান। আজও এই ঝিলটি ৭০টিরও বেশি গ্রামীণ মানুষের পানীয় জল ও সেচের চাহিদা মেটায়।
আজ যখন দিকে দিকে জল নিয়ে দুশ্চিন্তা, তখন, “জল সংরক্ষণ কেন প্রয়োজনীয়” এই প্রশ্নের জবাব হিসেবে টলটল করছে হাজার বছর আগে খনন করা এই সরোবর। এক হাজার বছর ধরে না জানি কত প্রজন্মের মানুষ এই সরোবরের আশীর্বাদ ধন্য হয়েছেন, সঞ্জীবিত থেকেছেন।এই সরোবর একথা প্রমাণ করে যে, জল সংরক্ষণ নিয়ে আজ আমরা যে প্রস্তুতিই নিই না কেন, তার দ্বারা আগামী হাজার বছর ধরে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মানুষ উপকৃত হবেন। সেজন্য আজ নদী সংস্কার, সরোবর সংস্কার, লক্ষ লক্ষ পুষ্করিণী খনন, বর্তমানের পাশাপাশি ভবিষ্যতের প্রস্তুতিরও অংশ।
এই সরোবর সম্পর্কে বক্তব্য রাখতে গিয়ে আমি আপনাদের সকলের প্রতি আবেদন রাখব যে, সন্ত শ্রী রামানুজাচার্যের কর্মপদ্ধতিকে জনমানসে পৌঁছে দেওয়ার সময় জল সংরক্ষণ নিয়ে আজ কী কী করা যায়, সে বিষয়েও সাধারণ মানুষকে সক্রিয় করে তুলুন।
এখানে সমবেত বিভিন্ন সংস্থার নেতৃবৃন্দের প্রতি একটি আবেদন রাখতে চাই, ২০২২ সালে ভারত যখন স্বাধীনতার ৭৫তম বর্ষে পদার্পণ করবে, তারই প্রাক্কালে যেগুলি আমাদের পেছনে টেনে রেখেছে আমরা সেই দুর্বলতা ও ত্রুটি ইত্যাদি নিয়ে কাজ করে চলেছি। আপনারাও নিজেদের জন্য পরিমাপযোগ্য ও বাস্তবে অর্জন সম্ভব এমন সব লক্ষ্য স্থির করুন, এই অনুরোধ করি।
আপনারা লক্ষ্য স্থির করতে পারেন যে, ১০ হাজার গ্রামে পৌঁছবেন, কিংবা ৫০হাজার গ্রামে পৌঁছবেন।
আমার আবেদন সন্ত শ্রী রামানুজাচার্যের রাষ্ট্র ধর্মে চেতনা জাগ্রত করে তোলা বাণীগুলির পাশাপাশি বর্তমান প্রতিস্পর্ধাগুলির কথা মাথায় রেখে মানবকল্যাণ, নারীকল্যাণ ও গরিব কল্যাণের ক্ষেত্রেও সাধারণ মানুষকে সক্রিয় করে তুলুন।
এই শব্দগুলির মাধ্যমে আজ আমার বক্তব্য সম্পূর্ণ করছি। আমি আরেকবার আপনাদের সকলের কাছে কৃতজ্ঞতা জানাই। আপনারা আমাকে সন্ত শ্রী রামানুজাচার্যের স্মৃতিতেডাকটিকিট প্রকাশ করার সুযোগ দিয়েছেন।
আপনাদের সকলকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।

                       (ছবি: বৈষ্ণবাচার্য শ্রীরামানুজ)

(ছবি: শ্রীরামানুজাচার্য ডাকটিকেট অনুষ্ঠানে শ্রীনরেন্দ্র মোদী)


-----------------------------------------------------------------------------------------------------------
দ্রষ্টব্যঃ—
উপর্যুক্ত ভাষণটি হিন্দি হতে ভাষান্তরিত ৷ মূল ভাষণটি দেখুন ভিডিওতে- https://m.youtube.com/watch?v=l6KgrH875QU
*এছাড়াও নরেন্দ্র মোদী ভারতের ৭০তম স্বাধীনতা দিবসেও বিশেষভাবে শ্রীরামানুজাচার্যের কথা উল্লেখ করেন: PM Narendra Modi Speech About Sri Ramanujacharya at Redfort on 70th Independence Day

রবিবার, ১৫ অক্টোবর, ২০১৭

শ্রীকৃষ্ণ কি শ্রীহরির কেশ হতে উৎপন্ন?

মূর্খ মর্দ্দন : পর্ব-১


নব্য আর্যসমাজীরা লেখে, //কৃষ্ণ যে পরমাত্বার একটি কেশের অংশ মাত্র, তা মহাভারতের আদিপর্বেও বর্ণনা করা হয়েছে এবং গীতাতেও অর্জুন হৃষীকেশ বলেই ডেকেছেন। দেখুন-
.
"দেবগন কর্তৃক প্রার্থিত হয়ে শ্রী হরি কেশদ্বয় উৎপাটন করলেন। তার একটি শুক্ল অপরটি কৃষ্ণবর্ণ। সেই কেশদ্বয় যদুকুল মহিলা রোহিনী এবং দেবকীতে আবিষ্ট হইয়াছিলো। শ্বেতবর্ণ কেশ বলভদ্র এবং কৃষ্ণবর্ণ কেশ কৃষ্ণরূপে উক্ত হন" 
#মহাভারত, আদিপর্ব ১৯৬।৩২-৩৩.//

#জবাবঃ মহাভারতের এই অংশটুকু তুলে ধরে নব্য ভন্ড আর্যসমাজীরা শ্রীকৃষ্ণকে স্বয়ং শ্রীহরি পরমেশ্বর না বলে, শ্রীহরির একটি অংশমাত্র প্রতিপন্ন করতে চায় ৷ তাদেরকে জিজ্ঞাসা করি- এখানে কেশ অর্থ কি চুল বুঝিতেছ? যদি তাহাই বোঝো তাহলে তো তোমাদের নিরাকারবাদ রসাতলে গেল!! মূলতঃ “এই কেশশব্দ অংশুবাচী অর্থাৎ কিরণ বলিয়া কথিত ৷ অতএব আমার যে কিরণরাজী প্রকাশিত হয় তাহা আমার কেশ সংজ্ঞায় অভিহিত ৷ সেইহেতু সর্বজ্ঞ মহর্ষিগণ আমাকে কেশব বলিয়া থাকেন ৷” মহাভারতের শান্তিপর্ব্বোক্ত মোক্ষধর্মপর্ব্বাধ্যায়ে অর্জুনের প্রতি শ্রীকৃষ্ণ এইরুপ বলেছেন ৷ অতএব শ্রীহরি কৃষ্ণ অংশু নিয়ে দেবকীদেবীতে আবিষ্ট হয়ে শ্রীকৃষ্ণরুপে আবির্ভূত হয়েছিলেন এবং তাঁর শ্বেত অংশু রোহিণীদেবী গর্ভস্থ অনন্তনাগাবতার বলরামে প্রবিষ্ট হয়েছিল— ইহাই তাৎপর্য ৷ মহাভারতের অন্যান্য অংশ মিল করে দেখলে ইহা সহজেই বোধগম্য হবে ৷

এরপর উক্ত মহাভারতেই শ্রীকৃষ্ণ তাঁর ‘হৃষীকেশ’ নামেরও ব্যাখ্যা করেছেন : অগ্নি সূর্য প্রভৃতি তাপ ও কিরণ দ্বারা জগতকে আহ্লাদিত (হৃষ) করে, আর সেই কিরণরাজি ভগবানের কেশ সংজ্ঞায় অভিহিত হয়; এজন্যই তাঁহার নাম হৃষীকেশ ৷
অথবা, গীতার টীকাকারদের ব্যাখ্যা অনুযায়ী—
হৃষীকেশ= হৃষীক (ইন্দ্রিয়) + ঈশ (কর্তা) ৷ 
অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণ ইন্দ্রিয়গণের পরিচালক পরমাত্মা হওয়ায় তাঁর নাম হৃষীকেশ ৷
গীতায় সর্বপ্রথম শ্রীকৃষ্ণের উদ্দেশ্যে হৃষীকেশ নামটি ব্যবহৃত হয়েছে ১/১৫ শ্লোকে ৷ এ শ্লোকের টীকায় মধুসূদন সরস্বতী লিখেছেন, ‘সর্ব্বেন্দ্রিয় প্রেরকত্বেন সর্ব্বান্তর্যামি সহায়ঃ পান্ডবানামিতি কথয়িতুং হৃষীকেশপদং’ ৷

অতএব, সম্পূর্ণ মহাভারত না জেনে শ্রীকৃষ্ণকে হরির অংশরুপে প্রতিপন্ন করার অপচেষ্টা বৃথা ৷ কারণ উক্ত মহাভারতেরই বিভিন্ন স্থানে বলা হয়েছে যে শ্রীকৃষ্ণ অংশ নন, তিনি স্বয়ং শ্রীহরি বিষ্ণু ৷ প্রমাণ দেখুন-

অনুগ্রহার্থং লোকানাং বিষ্ণুলোকনমস্কৃতঃ ৷
বসুদেবাত্তু দেবক্যাং প্রাদুর্ভূতো মহাযশাঃ ৷৷
“ত্রিজগতের পূজনীয় মহাযশস্বী স্বয়ং বিষ্ণু লোকের প্রতি অনুগ্রহ করিবার জন্য বসুদেব-দেবকীতে আবির্ভূত হইয়াছিলেন ৷” (আদিপর্ব, ৫৮/১৩৮)

অসতাং নিগ্রহার্থায় ধর্ম্মসংরক্ষণায় চ ৷
অবতীর্ণো মনুষ্যাণামজায়ত যদুক্ষয়ে ৷
স এষ ভগবান্ বিষ্ণুঃ কৃষ্ণতি পরিকীর্ত্ত্যতে ৷৷
“সেই ভগবান বিষ্ণুই দুর্জ্জনের নিগ্রহ এবং ধর্ম্মরক্ষার জন্য মনুষ্যমধ্যে অবতীর্ণ হইয়া যদুকুলে জন্মিয়াছিলেন; তাঁহাকেই ‘কৃষ্ণ’ বলা হয় ৷” (বনপর্ব, ২২৬/৬৮)

কর্ণের অর্জুনকে বধ করার মনোবাসনা বুঝতে পেরে ইন্দ্রদেব কর্ণকে বলেন—
যমাহুর্বেদবিদ্বাংসো বরাহমজিতং হরিম্ ৷
নারায়ণমচিন্ত্যঞ্চ তেন কৃষ্ণেন রক্ষ্যতে ৷৷
“বেদবিদ্বান লোকেরা যাহাকে বরাহ, অজিত, হরি ও অচিন্তনীয় নারায়ণ বলেন, সেই কৃষ্ণই তাহাকে রক্ষা করেন ৷” (বনপর্ব ২৬৪/২৬)

সমগ্র মহাভারত জুড়ে শ্রীকৃষ্ণের ঈশ্বরত্ব বিষয়ক এইরুপ অসংখ্য প্রমাণ আছে ৷ তথাপি যদি সেই নব্য ভন্ড আর্যসমাজীগণ নিজেদের মূঢ়়তাবশত শ্রীকৃষ্ণকে ঈশ্বর না মানে, তবে তারা নরাধম ব্যতীত আর কি?
যশ্চ মানুষমাত্রোহ‘য়মিতি ব্রুয়াৎ স মন্দধীঃ ৷
হৃষীকেশমবিজ্ঞানাত্তমাহু পুরষাধমম্ ৷৷
—“যে লোক অজ্ঞানবশতঃ এই হৃষীকেশকে মানুষমাত্র বলিবে সে মন্দবুদ্ধি, সকলে তাকে ‘নরাধম’ বলিবে ৷”
(মহাভারত, ভীষ্মপর্ব, ৬৫/১৯)

সোমবার, ৯ অক্টোবর, ২০১৭

শঙ্করাচার্য কি শ্রীকৃষ্ণকে ঈশ্বর মানতেন?


নব্য আর্যসমাজীদের মধ্যে একটা ভ্রান্ত ধারণা তৈরি হয়েছে যে আদি শঙ্করাচার্য নাকি অবতারবাদ মানতেন না এবং শ্রীকৃষ্ণকে বিষ্ণুর অবতার ও স্বয়ং ভগবান বলে মানতেন না। হতে পারে আর্যসমাজীরা কেবল হিন্দুদের বিভ্রান্ত করার জন্য ও ভুল পথে চালিত করার জন্য এইরকম ভ্রান্ত অপপ্রচার করে থাকে। যাই হোক, বর্তমান হিন্দু যুবসমাজ যাতে এইরকম ভুল ধারণার বশবর্তী না হয় তার জন্য আর্য সমাজীদের এই ভ্রান্ত ধারণার নিরসন হওয়া দরকার।

জগদগুরু আদি শঙ্করাচার্য তাঁর লেখা গীতাভাষ্যের উপক্রমণিকাতেই স্বীকার করেছেন যে শ্রীকৃষ্ণ বিষ্ণুর অবতার ছিলেন ও সাক্ষাৎ ভগবান ছিলেন। তিনি লিখেছেন, ‘.....দীর্ঘেণ কালেন অনুষ্ঠাতৃণাং কামোদ্ভবাদ হীয়মানবিবেকবিজ্ঞানহেতুকেন অধর্মেণ অভিভূয়মানে ধর্মে প্রবর্ধমানে চ অধর্মে, জগতঃ স্থিতিং পরিপিপালয়িষুঃ স আদিকর্তা নারায়ণাখ্যো বিষ্ণুঃ ভৌমস্য ব্রহ্মণো ব্রাহ্মণত্বস্য রক্ষণার্থং দেবক্যাং বসুদেবাদ্ অংশেন কৃষ্ণ কিল সম্বভূব।’
অর্থাৎঃ  বহুকাল পরে যখন ধর্মানুষ্ঠানকারীদের অন্তঃকরণে কামনার বৃদ্ধি হওয়ার কারণে ও বিবেকবিজ্ঞানের হ্রাস হওয়ার কারণে উৎপন্ন অধর্মের দ্বারা ধর্ম ক্ষীণ হতে লাগল তখন জগতের স্থিতি রক্ষা করার জন্য আদিকর্তা নারায়ণনামক শ্রীবিষ্ণুভগবান ভূলোকের ব্রহ্মের অর্থাৎ ভূদেব(ব্রাহ্মণদের) ব্রাহ্মণত্ব রক্ষা করার জন্য শ্রীবসুদেব দ্বারা দেবকীর গর্ভে নিজের অংশে (লীলাবিগ্রহদ্বারা) শ্রীকৃষ্ণরূপে প্রকট হলেন।

তিনি আরো লিখেছেন ‘স চ ভগবান্ জ্ঞানৈশ্বর্যশক্তিবলবীর্যতেজোভিঃ সদা সম্পন্নঃ ত্রিগুণাত্মিকা বৈষ্ণবীং স্বাং মায়াং মূলপ্রকৃতিং বশীকৃত্য অজঃ অব্যয়ো ভূতানাম্ ঈশ্বরো নিত্যশুদ্ধবুদ্ধমুক্ত­স্বভাবঃ অপি সন্ স্বমায়য়া দেহবান্ ইব জাত ইব চ লোকানুগ্রহং কুর্বন্ ইব লক্ষ্যতে।’
অর্থাৎঃ  জ্ঞান, ঐশ্বর্য, শক্তি, বল, বীর্য আর তেজ আদি সম্পন্ন সেই ভগবান যদিও অজ, অবিনাশী, সকল ভূতের ঈশ্বর ও নিত্য, শুদ্ধ, বুদ্ধ, মুক্ত স্বভাব বিশিষ্ট হন, কিন্তু তিনি নিজের ত্রিগুণাত্মিকা মূল প্রকৃতি বৈষ্ণবী মায়াকে বশীভূত করে নিজের লীলাদ্বারা শরীর ধারণ করেন বলে ও লোকানুগ্রহ করে থাকেন বলে প্রতিভাত হতে থাকেন। (অর্থাৎ পরমার্থতঃ সাধারণ মনুষ্যের ন্যায় দেহধারণ করেন না)



গীতা ৯/১১ এর ভাষ্যে শঙ্করাচার্য বলেছেন, ‘মূঢ়গণ ভগবানের নিত্যমুক্ত নিত্যবুদ্ধ সত্তার কথা জানেনা এবং তিনিই যে সর্বভূত মহেশ্বর একথা তারা জানে না, পরন্তু তিনি যখন লোক সম্বন্ধিনী মনুষ্যতনু আশ্রয় করেন তখন তাঁকে শুধুমাত্র মানুষ মনে করে অবজ্ঞা করে, এবং পরমাত্মাতত্ত্ব অপেক্ষাও অন্তরতম সেই তত্ত্বকে অবজ্ঞা করার জন্য বারংবার সংসারে অকিঞ্চন ও শোচনীয় দশায় পতিত হয় ৷’


সাম্প্রতিক পোস্ট

পুরুষ—কৃষ্ণ ৷৷ প্রকৃতি—রাধা

 পুরুষ—কৃষ্ণ ৷৷ প্রকৃতি—রাধা ======================= যোগেনাত্মা সৃষ্টিবিধৌ দ্বিধারূপো বভূব সঃ ৷ পুমাংশ্চ দক্ষিণার্ধাঙ্গো বামাঙ্গঃ প্রকৃতিঃস্...

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ