=====================
আহ্বান ও মীরার সাড়া
=====================১৫২৩ খ্রীষ্টাব্দে মীরার বয়স যখন মাত্র সতেরো, তাঁর স্বামী ভোজরাজ দেহত্যাগ করলেন । কোন কোন জীবনীতে ভোজরাজকে চিত্রিত করা হয়েছে একজন ঈর্ষাপরায়ণ স্বামীরূপে ৷ যিনি মীরার প্রবল ঈশ্বরানুরক্তি— যা তাঁকে মধুর দাম্পত্য সুখ হতে বঞ্চিত করেছে, তার প্রতি বিদ্বেষযুক্ত হয়ে স্ত্রী মীরার প্রতি অত্যন্ত কঠোর ব্যবহার করতেন । আবার কেউ কেউ এরূপ ধারণার বিরোধিতা করেছেন, তাঁদের মতে ভোজরাজ একজন বিরহী স্বামী, যিনি স্ত্রীকে অত্যন্ত ভালবাসলেও তাঁর হৃদয় লাভে অসমর্থ হয়েছিলেন, কারণ মীরার মন সম্পূর্ণতই ভগবৎ প্রেমে বাঁধা পড়েছিল ।
যাইহোক, স্বামীর মৃত্যুর পর মীরার জীবনের এক নতুন অধ্যায় শুরু হলো । সে অধ্যায়টি তাঁর জীবনে মহা পরীক্ষার এবং সেই সঙ্গে তা সাফল্যেরও বটে । কথিত আছে, এইসময় তিনি রইদাস নামক এক বৈষ্ণব সাধুর নিকট মন্ত্রদীক্ষা গ্রহণ করেন । তাঁর বৈধব্য অতি স্বাভাবিকভাবেই তাঁর আধ্যাত্মিক সাধনা তীব্রতর করেছিল । এখন গুরুর নিকট নির্দিষ্ট পথনির্দেশ লাভ করে তাঁর ব্যাকুলতা, তন্ময়তা, সাধুসঙ্গ লাভের জন্য তীব্র স্পৃহা, গতানুগতিক সাংসারিক জীবনের প্রতি প্রবল বিতৃষ্ণা প্রভৃতি অনন্তগুণে বৃদ্ধি পেল এবং সে সকল অহরহ তাঁকে উত্ত্যক্ত করতে থাকল ।
ইতিমধ্যে শ্বশুর সংগ্রাম সিংহের মৃত্যু হয়েছে এবং ভোজরাজের ভ্রাতা কুমার বিক্রমজিৎ রাণা চিতোরের সিংহাসনে আরোহণ করেছেন । তিনি মীরার প্রতি কঠোর নিয়ম জারি করতে বিন্দুমাত্র বিলম্ব করলেন না । কিন্তু মীরার সাধনভজন একান্তভাবেই তাঁর নিজস্ব ধারায় অগ্রসর হতে থাকল ।
তিনি গিরিধারী গোপালের সম্মুখে নৃত্য করতেন, আপ্লুত হৃদয়ে ভজন নিবেদন করেন । সাধুসঙ্গ লাভের সুযোগ তো কিছুমাত্রও হারান না ।
সাধুসঙ্গ লাভের তৃষ্ণা তাঁর এতই তীব্র ছিল যে, রাজপরিবারের প্রথাগত বিধিনিয়ম সকল শিথিল করেও অধ্যাত্ম প্রেরণালাভের জন্য সাধুভক্তের সঙ্গ করতেন । অশুদ্ধচিত্ত মানুষজনের স্বভাবতই মীরার এই সাধুপ্রীতির অর্থ বোধগম্য হয়নি ।
মহারাজা বিক্রমজিৎ রাণা অতঃপর আদেশ জারি করলেন, মীরাকে তার ঐ অশোভন নৃত্য-গীত বন্ধ করতে হবে এবং আরো আপত্তিকর, তার ঐ সাধুদের সঙ্গে মেলামেশা ত্যাগ করতে হবে । তিনি না একজন নারী? তিনি না বিধবা? তবে কেন তাঁর এই পুরুষ মানুষদের সঙ্গলাভে ব্যাকুলতা? বিক্রমজিৎ সেই অপাপাবিদ্ধা পবিত্রা নারীর বিরুদ্ধে কলঙ্ক রটনা করতেও কিছুমাত্র বিচলিত হলেন না ।
রাজ-অন্তঃপুরে মীরা যখন এরূপে সাধনভজনে বাধাপ্রাপ্ত হলেন, তিনি নিকটবর্তী এক দেবালয়ে আশ্রয় গ্রহণ করে সেখানেই তাঁর অভিরুচি অনুযায়ী সাধনে মগ্ন হলেন । তাঁর অভূতপূর্ণ দিব্য অনুরাগ ও প্রেম শীঘ্রই মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করল এবং ক্রমশই নিকট ও দূর-দূরান্তর হতে দলে দলে ভক্তরা তাঁর নিকট আধ্যাত্মিক অনুপ্রেরণা লাভের আশায় এসে জমায়েত হতে থাকল । ফলে মহারাণা ও পরিবারের অপরাপর লোকজনের ক্রোধ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকল । মীরাকে অতঃপর আক্ষরিত অর্থেই প্রাসাদের অভ্যন্তরে বন্দী করা হলো এবং তাঁর উপর একের পর এক নানাপ্রকার অমানবিক নির্যাতন চলতে থাকল ।
মীরা নিছক এক ঈশ্বরপ্রেমিক মাত্রই ছিলেন না, তিনি কবিও বটে । তাঁর কাব্য, যা তিনি ভজনাকার তাঁর গিরিধারীলালের নিকট নিবেদন করতেন তাতে তাঁর প্রতি হওয়া নির্যাতন সম্পর্কে কিঞ্চিৎ আভাস মেলে । সে নির্যাতন কি অমানুষিক ছিল তা জেনে বিস্মিত হতে হয়, কিন্তু মীরা কত সহজে সে সকল সহ্য করেছিলেন । একটি ভজনে মীরা গেয়েছেন তাঁর অভিজ্ঞতার কথা—
“মীরা সুখী তার প্রিয়ের পূজায় ।
ঝুড়ি ভরে সর্প আসে মীরার তরে -
রাণার উপহার ।
ঝুড়ি খুলে দেখে মীরা প্রভু স্বয়ং ।
রাণা পাঠান পেয়ালা ভরা বিষ ,
মীরা পান করে তা আকন্ঠ ।
বিষ হয় অমৃত ,
তাঁর (শ্রীকৃষ্ণের) কারসাজিতে ।
আসে কন্টকশয্যা রাণার কাছ হতে ,
মীরা দেখে সে যে ফুল শয্যা ।
সকল বিপদ তুচ্ছ হয়
গিরিধারীর সর্তক রক্ষণে ।
প্রেম মদিরায় মাতোয়ারা মীরা
হাসে, নাচে, গায় প্রভুর নাম,
উৎসর্গীকৃত সে যে
দয়িতের চরণে ।”
ভক্তজীবন অবলম্বন করে ভগবানের কৃপা বহে শতধারে সহস্র বিচিত্র পথে । গান্ধী হত্যার সংবাদ শুনে বার্ণার্ড শ' আর্তি প্রকাশ করেছিলেন, “এই দুনিয়ায় ভাল মানুষ হবার এই তো ফল ৷” শ্রীরামচন্দ্রের ভক্ত ছিলেন গান্ধীজী । মাত্র কিছুদিন আগেই এক প্রার্থনা সভায় বোমা বিস্ফোরণ হওয়া সত্ত্বেও তিনি অক্ষত আছেন জেনে লোকে বলেছিল ‘রাখে হরি মারে কে?’ কিন্তু তার অল্পদিন পরেই সেই শ্রীহরি তাঁকে খুনীর বুলেট হতে বাঁচাতে এগিয়ে এলেন না ।
পুরাণে কথিত বিষ্ণুর বালকভক্ত প্রহ্লাদকে হাতির পায়ের নিচে ফেলে, পাহাড়ের চূড়া হতে ফেলে অথবা বিষ প্রয়োগাদি বিবিধ উপায়েও মারা সম্ভব হয়নি । আবার সেই ঈশ্বর যীশুকে ক্রুশবিদ্ধ বেশ নির্বিঘ্নেই ঘটেছিল । কিন্তু মীরার ক্ষেত্রে গিরিধারীলাল তাঁকে সর্বতোভাবে রক্ষা করে যাচ্ছিলেন ।
ভগবানের একনিষ্ট ভক্তদের জীবনের বিভিন্ন ঘটনা আলোচনা করে আমরা কখনো বা হতবুদ্ধি হয়ে পড়ি ।
আমাদের পক্ষে ঈশ্বর কৃপার প্রকৃত অর্থ সম্যক উপলব্ধির প্রধান বাধা এই যে, আমরা স্থূলদৃষ্টিতে ভক্তিকে একপ্রকার বিনিয়োগ বলে বিবেচনা করি । আমি ভগবানকে ভক্তি করি; সুতরাং তাঁকে হতে হবে একাধারে আমার ব্যক্তিগত পুলিশ, চিকিৎসক, উকিল ইত্যাদি সবকিছু । অর্থাৎ তাঁকে হতে হবে আমার আপৎকালীন লাইফবোট । ভক্তির নগদ বিদায় হিসাবে পাওয়া চাই স্বর্গের শিলমোহরাঙ্কিত সুরক্ষা পত্র । ধর্মক্ষেত্রে এরূপ মনোভাব হলো ব্যবসাদারি, বা প্রশয় লাভের আগাম অঙ্গীকারপত্র গ্রহণ করে তার বিনিময়ে বিবিধ অবৈধ উপায়ে ফলাও উপায়ে ফলাও কারবার করা !
গরল যখন অমৃত রূপান্তরিত হয় তখন সত্যতা বজায় থাকে, আবার যখন বিষ সক্রিয় হয় তখনও । যারা সৎকর্ম করতে ব্রতী হয়ে তার শুভাশুভ কর্মফল শান্তচিত্তে গ্রহণ করতে প্রস্তুত থাকে, ভগবানের কৃপা তাদের উপরই বর্ষিত হয় । মীরা বিষ অমৃতে পরিণত হবেই এমনটি আশা করে তা গ্রহণ করেছিলেন এমন নয়, তিনি তা গ্রহণ করেছিলেন পরম প্রেমাষ্পদের প্রেরতি প্রসাদ জ্ঞানে । কৃপার সত্যতা প্রমাণিত হয় ভগবান প্রদত্ত সেই শক্তির আবির্ভাব চাক্ষুষ করে, যার বলে ভক্ত যে কোন ফলের জন্য সদা প্রস্তুত থাকে, নিঃশঙ্ক থাকে ।
মহাযোগী পত্তহারী বাবাকে যখন সর্প দংশন করেছিল, তিনি বলেছিলেন, “প্রভুর নিকট হতে দূত প্রেরিত হয়েছে । " ভাল-মন্দ, আনন্দ-বেদনা, আনুকূল্য-প্রতিকূলতা, জন্ম-মৃত্যু প্রভৃতি সকলই সেই পরমপ্রিয়ের নিকট হতে প্রেরিত বার্তা । যখন আমরা এই দ্বন্ধমূলক বিষয়সমূহ গ্রহণীয় অথবা বর্জনীয় রূপে না দেখে তাদের ঈশ্বর প্রেরিত প্রেম প্রসাদ বলে গ্রহণ করতে শিখি, তখনই যথার্থ ভক্তির উদয় হয়েছে বলা যায় ।
ঈশ্বর কৃপার প্রমাণ অনুকূল অথবা প্রতিকূল ঘটনার উপর নির্ভরশীল নয়, তার প্রমাণ আত্মশক্তির পরিচয়ে, যা ঈশ্বরের দান মাত্র । সেই দেবদত্ত শক্তি বলে আনন্দ অথবা দুঃখ যাই আসুক না কেন, হাসিমুখে গ্রহণ করা সম্ভব হয় । ঈশ্বর সকল সময়ে পরীক্ষা নেন আমাদের থেকে । যখন সুখে থাকি তখন ভুলে যায়, যখন দুঃখী হই তখন মনে পড়ে । কারণ ঈশ্বরকে ভুলে থাকার কারণে কত কিছুর সম্মুখীন হতে হয় ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন