বুধবার, ২২ নভেম্বর, ২০১৭

কুমারিল ভট্ট


বেদজ্ঞানী সেনাপতিরাই আমাদের ধর্ম রক্ষাকারী ৷ কোন যোদ্ধার তরবারি নয়, বৈদিক মন্ত্রই আমাদের রক্ষাকবচ ।
আজ তেমনি এক বৈদিক সেনানায়কের কথা আপনাদের কাছে তুলে ধরবো যার নাম ‘কুমারিল ভট্ট’।

কুমারিল ভট্টের জন্ম ৭০০ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে, তিনি দক্ষিণ ভারতীয় ব্রাহ্মণ ছিলেন । তাঁর জন্মস্থান চোলদেশে । তাঁর আবির্ভাব কালে সমগ্র ভারত বৌদ্ধ এবং জৈন ধর্মের কদর্য ধর্মাচারে আক্রান্ত ছিল। ভারতে বৈদিকধর্মের পুনঃপ্রতিষ্ঠাকালে উনি ছিলেন প্রধান সেনাপতি। কুমারিল বৌদ্ধ জৈন প্রভৃতি ভারতের যাবতীয় অবৈদিক ধর্মাবলম্বিগণকে বিচারে পরাজিত করে বৈদিকধর্মের কর্মকাণ্ডের পুণঃপ্রতিষ্ঠা করেন। বৌদ্ধ, জৈনরা যেমন বেদবিরোধী ছিল, উনি তেমনি বেদানুরাগী, বৌদ্ধরা যেমন বেদ ছেদনকারী, ইনি তেমনি বেদ প্রতিষ্ঠাকারী।

কুমারিল ভট্ট শৈশব থেকেই বেদানুরাগী ছিলেন এবং পরে একজন বেদজ্ঞ পণ্ডিত হয়ে ওঠেন ।
কুমারিল ছিলেন প্রসিদ্ধ বৌদ্ধ পণ্ডিত ধর্মকীর্তির কাকা। ধর্মকীর্তি ১৮ বছর বয়সের মধ্যে বেদ বেদাঙ্গ ব্যাকরণ সর্বশাস্ত্রপারগামী হন। ধর্মকীর্তি শাস্ত্রজ্ঞানের জন্য কুমারিলেরর শিষ্য হন। কিন্তু বৌদ্ধধর্মে আকৃষ্ট হয়ে মগধদেশীয় প্রসিদ্ধ বৌদ্ধগুরু ধর্মপালের শিষ্য হন। এই ধর্মপালের কাছে বৌদ্ধমত শিক্ষা নিয়ে দেশে ফিরে ধর্মকীর্তি কুমারিলকে বিচারে পারাজিত করে আর অন্ধ স্নেহে কুমারিলও তার পরাজয় স্বীকার করে এবং পণ-অনুসারে বৌদ্ধ হতে বাধ্য হন।
ফলতঃ নালন্দা এসে ধর্মপালের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। বৌদ্ধ ন্যায়শাস্ত্র শিক্ষা করতে থাকেন কিন্তু কুমারিল অন্তরে বৈদিক থেকে যান। একদিন বৌদ্ধগুরু সভামধ্যে শাস্ত্রব্যাখ্যা করেছিলেন। বহু শ্রোতাদর্শক এবং কুমারিল এবং অন্যান্য শিষ্য সেই উপস্থিত ছিলেন। বৌদ্ধ গুরু শাস্ত্রব্যাখ্যা করতে করতে ভীষণভাবে বেদের নিন্দা করতে লাগলো, কুমারিল পক্ষে অসহ্য লাগতে লাগলো এই বেদ নিন্দা। তিনি নীরবে অশ্রু বিসর্জন করতে লাগলেন। অন্যান্য ভিক্ষু এবং গুরু বিরক্ত হয়ে কুমারিল কে বলেন, “আপনার ক্রন্দনের কারন কি?? মনে হচ্ছে আপনার বেদের উপর শ্রদ্ধা এখনও যায় নি এবং আপনি ভান করে বৌদ্ধ সেজে আমাদের বিদ্যা গ্রহণ করছেন।”
কুমারিল গুরুবাক্যে মর্মাহত হয়ে উত্তেজিত হয়ে বিনীতভাবে বললেন, “আপনি বেদবিষয়ে অযথা নিন্দা করছেন এটাই আমার রোদনের হেতু।”
এতে গুরু আরো রুষ্ট হলেন কুমারিরকে তর্কে আহ্বান করলেন ক্রমে গুরুর সঙ্গে কুমারিল বেদের প্রামাণ্য নিয়ে ভীষণ বিচার আরাম্ভ হলো। বহুক্ষণ বিচারের পর বৌদ্ধ গুরু কুমারিলের যুক্তিশরে জর্জরিত হতে লাগলেন। শেষে কুমারিল বললেন “সর্বজ্ঞের উপদেশ ভিন্ন জীব সর্বজ্ঞ হইতেই পারে না। বুদ্ধ বেদজ্ঞানে জ্ঞানী হইয়া বেদ মানেন নাই— ইহা তাহার চৌর্য ভিন্ন আর কি?” এই শুনে বৌদ্ধগুরু ক্রুদ্ধ হয়ে বলেন, “তোমায় এই উচ্চ প্রাসাদ হইতে ফেলিয়া দিয়ে প্রাণবধ করা উচিত ৷” গুরুর কথা শুনে আগের থেকে উত্তেজিত বৌদ্ধ শিষ্যরা কুমারিল কে বলপূর্বক উঁচু প্রাসাদ থেকে ফেলে দিলেন। পতনকালে কুমারিল উচ্চৈঃস্বরে বললেন, “বেদ যদি প্রমাণ হয়, তাহা হইলে আমি যেন অক্ষত শরীরে জীবিত থাকি ৷”
মাটিতে পরেও কুমারিল প্রাণ গেলোনা এমনকি বিশেষ আঘাতো পেলেননা। বৌদ্বরা এই দেখে একেবারে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন । কুমারিল তখন বললেন, “ওহে অহিংসাপরায়ণ বৌদ্ধগণ! আমি দেখিতেছি আমার একটি চক্ষুতে একটুমাত্র আঘাত লাগিয়াছে। আমার এ ক্ষতিও হইত না, যদি আমি ‘বেদ যদি প্রমাণ হয়’ এইরূপ সংশয়াত্মক বাক্যপ্রয়োগ না করিতাম ৷” বৌদ্ধগণ তখন কুমারিল দৈবশক্তি দেখে পালিয়ে গেলো এবং চিন্তিত ও শঙ্কিত হয়ে পরলেন । পরবর্তীকালে বৌদ্বরা এক বিরাট বিচারের ব্যাবস্থা করলেন। দেশবিদেশ থেকে বৈদিক এবং বৌদ্ধ পণ্ডিতরা সেখানে উপস্থিত হলেন। দেশের রাজাদের সামনে বৌদ্ধগুরু এই পণ রাখলেন বিজেতার মত গ্রহণ অথবা তুষানলে প্রাণত্যাগ উভয় পক্ষ এই পণে সম্মত হলেন। এই তর্কসভায় কুমারিলর ভ্রাতুষ্পুত্র ধর্মকীর্তিও উপস্থিত ছিলেন। বৌদ্ধরা যথাসাধ্য চেষ্টার পরেও কুমারিল কাছে হার স্বীকার করলো। তখন বৌদ্ধ গুরু বললেন, “আমি বিচারে পরাজিত হইয়াছি বটে, কিন্তু আমি বেদকে স্বীকার করবো না, যাহা হউক আমি ভগবান বুদ্ধের মত ত্যাগ করিব না, প্রাণত্যাগ আমি বরং করিলাম ৷” তুষানলে সর্বসমক্ষে প্রাণ ত্যাগ করলেন।

এরপর কুমারিল জৈনগণকে পরাস্ত করে দক্ষিণ বিজয় করেন ৷ এসময় বহু জৈন বৈদিকধর্মে ফিরে আসে ৷ কুমারিল কেবল দ্বিগবিজয় করেই ক্ষান্ত হননি, তিনি বৈদিক যাগ-যজ্ঞাদির ফল প্রদর্শন করে সকলকে বৈদিকধর্মের প্রতি শ্রদ্ধালু করতেন ৷ তার প্রচেষ্ঠাতেই তখন বেদ-বেদান্তের পঠনপাঠন পুণরায় আরম্ভ হয় ৷ নতুবা বৌদ্ধ ও জৈনগণ যেরুপে বৈদিকগ্রন্থাদি ভস্মাৎ করেছিল এবং যেভাবে রাজশক্তিবলে নিজ নিজ মত প্রতিষ্ঠা করেছিল তাতে আর বৈদিকধর্মের পুণঃপ্রতিষ্ঠার আশা ছিল না ৷


(শঙ্করাচার্য ও কুমারিল ভট্ট)


                   Related post : শঙ্করাচার্য ও বেদান্ত-দর্শন


২টি মন্তব্য:

  1. গাঞ্জানন্দ বালার্য১৪ মে, ২০১৮ এ ১১:০৫ AM

    দয়ানন্দকে ওই সব জৌন আর বৌদ্ধদের সাথে ডিবেট করতে দেওয়া উচিত ছিল।যত বালপাকনা বের হয়ে যেত।

    উত্তরমুছুন
  2. বুদ্ধের দর্শনকে আশ্রয় করে বর্তমানে ভারত বহিঃবিশ্বে নিজেকে উপস্থাপন করে। বৈদিক দর্শন অর্থাৎ দস্যু রত্নকরের (বাল্মিকী) কাল্পনিক গল্প কাহিনী ভারতের বাহিরে অসার ।
    বুদ্ধই ছিলেন ভারতের বৈদিক দর্শনের তথা প্রাচীন সনাতনের প্রকৃত সংস্কারক। স্বামী বিবেকান্দন এটি অকোপটে স্বীকার করেছেন।
    এছাড়াও কর্ট্টক ব্রাহ্মণরা নিজেদের ষোলআনা ঠিক রাখতে তথা যাগযজ্ঞ বর্ণপথা, জাতিভেদ করে পুরো ভারতকে নরকে পরিনত করছে। বুদ্ধ এর বিরোধীতা করে সকলের জন্যে সমতা তৈরী করেছিলেন।
    শংকরাচার্য, শশ্মাঙ্ক, পুষ্যমিত্র, মিহিরকুল সবাই বৌদ্ধ নিধন করে ছিল। শুধুমাত্র ব্রাহ্মণ্যবাদকে প্রতিষ্ঠা করে পুরো ভারতকে জাতিবাদ বর্ণবাদের অন্ধকারে ডুবিয়ে দেয়।।
    এবং প্রাচীন সকল বৌদ্ধ বিহারগুলোকে দেব-দেবীর মন্দিরে রূপান্তর করেছিল। তৎমধ্যে পুরী জগন্নাথ মন্দির অন্যতম।
    ইতিহাসে সত্য কখনও গোপন থাকে না।
    বর্তমান বিশ্বের বুদ্ধ এবং বৌদ্ধের দর্শন বরাবরের মতোই প্রাসঙ্গিক।

    উত্তরমুছুন

সাম্প্রতিক পোস্ট

পুরুষ—কৃষ্ণ ৷৷ প্রকৃতি—রাধা

 পুরুষ—কৃষ্ণ ৷৷ প্রকৃতি—রাধা ======================= যোগেনাত্মা সৃষ্টিবিধৌ দ্বিধারূপো বভূব সঃ ৷ পুমাংশ্চ দক্ষিণার্ধাঙ্গো বামাঙ্গঃ প্রকৃতিঃস্...

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ