মঙ্গলবার, ২৮ নভেম্বর, ২০১৭

মহাবিজ্ঞানী দয়ানন্দ সরস্বতী

দয়ানন্দ মতবাদ খন্ডন : পর্ব-১


(সত্যার্থ-প্রকাশ, ৮ম সমুল্লাস)



মহাবিজ্ঞানী দয়ানন্দ সরস্বতীর মহা আবিষ্কার যে চন্দ্র, সূর্য, নক্ষত্রেও মনুষ্যাদি প্রাণী তথা মানুষ, পশুপাখি, গাছপালা ইত্যাদি আছে ৷ (কেউ হাসবেন না কিন্তু 😁)

চন্দ্র-নক্ষত্রের কথা নাহয় বাদই দিলাম, সূর্যের মধ্যে কি করে মনুষ্যাদি প্রাণী থাকা সম্ভব?? সূর্য একটি জ্বলন্ত অগ্নিপিন্ড যার অভ্যন্তরের তাপমাত্রা প্রায় ১ কোটি ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড, পৃষ্ঠের তাপমাত্রা প্রায় ৬ হাজার ডিগ্রি সেন্ট্রিগ্রেড ও পৃষ্ঠের ঠিক উপরি ভাগে তাপমাত্রা প্রায় ১০ লক্ষ ডিগ্রি সেন্ট্রিগ্রেড। এবার বলুন, এই তাপমাত্রায় কোন  প্রাণীর বসবাস করার কথা চিন্তা করাও কি চিন্তনীয় কিনা?
কিন্তু দয়ানন্দ এইরুপ কথা এত জোরের সহিত কি করে বললেন? উত্তর সোজা— তিনি ছিলেন নেশাখোর, তিনি গাঁজা ও হুকো টানতেন এরুপ প্রমাণ পাওয়া যায় ৷ এইসব অবৈজ্ঞানিক প্রলাপ নেশাগ্রস্থ পাগল ছাড়া আর কে বলতে পারে?
আবার এই দয়ানন্দই নাকি বেদজ্ঞানী, বেদভাষ্যকার ৷ এইরুপ নেশাগ্রস্থ পাগল যদি বেদের অর্থ নির্ণয় করতে যায়, তবে তা কতটা বিকৃত করতে পারে তা পাঠকগণ ভেবে দেখুন ৷



শনিবার, ২৫ নভেম্বর, ২০১৭

দয়ানন্দ-চরিত বিশ্লেষণ




আর্যসমাজের প্রতিষ্ঠাতা ‘স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী’, এই নাম হয় সন্ন্যাস গ্রহণের পরে, কিন্তু এর আগে তার কি নাম ছিল এবং তার পিতা-মাতার নাম কি দয়ানন্দ কখনো তা কারো কাছে বলেন নাই ৷ দয়ানন্দ নিজেকে ব্রাহ্মণ ঘরের সন্তান বলে দাবি করতেন, কিন্তু তিনি এমন কোন প্রমাণ উপস্থাপন করেননি যাতে তার কথা সত্য প্রমাণিত হয় ৷


দয়ানন্দ যখন বালক ছিলেন তখন তিনি একদিন তার পিতার সাথে শিবরাত্রি যাপন করছিলেন ৷ দয়ানন্দ দেখলেন যে কতগুলি ইঁদুর শিবমূর্তির গাত্র বেয়ে বেড়াচ্ছে ৷ তখন তিনি তার পিতাকে ডাকলেন, পিতা ইঁদুরগুলিকে তাড়িয়ে দিলেন ৷ দয়ানন্দ ভাবলেন- শিব যদি সর্বশক্তিমান ভগবান হন তবে ইঁদুরগুলো তিনি নিজে তাড়াতে পারলেন না কেন? এ ঘটনার পর থেকে তিনি মূর্তিপূজার প্রতি শ্রদ্ধাহীন হন ৷
(ভাবুন কান্ড, দয়ানন্দ আশা করেছিল ইঁদুর মারতে স্বয়ং ভগবান শিব ত্রিশুল হাতে হাজির হবেন!!! কিন্তু দয়ান্দের এ ভাবনা আসল না যে ভগবান কেন তাঁরই সৃষ্ট অবুঝ জীবকে অযথা মারতে যাবেন; বালক দয়ানন্দ যদি তার পিতার কাঁধে চড়ে উঠতো তবে কি তার পিতা তাকে ছুড়ে ফেলে দিতেন?? বরঞ্চ অবুঝ ছেলেকে আদরই কি করতেন না?)

এরপর দয়ানন্দ যখন যুবক, পিতা যখন দয়ানন্দের বিবাহের সকল আয়োজন সম্পন্ন করেছেন, তখন তিনি বাড়ি হতে পলায়ন করেন ৷
(যে মেয়েটির সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছিল তার কি দশা হয়েছিল?)

পলাতক দয়ানন্দ একদিন সকালে সিদ্ধপুরের নীলকন্ঠ মন্দিরে অবস্থান করছিলেন ৷ দয়ানন্দের পিতা এক বৈরাগীর কাছ থেকে দয়ানন্দের খবর পেয়ে সেই সময় সিপাহীসহ দয়ানন্দকে ধরতে আসলেন ৷ তখন দয়ানন্দ পিতার হাতে মার খাওয়ার ভয়ে মিথ্যা কথা বলেন যে তিনি স্বেচ্ছায় বাড়ি হতে পলায়ন করেন নাই, কোন অসৎ ব্যক্তির পরামর্শে এইকাজ করেছেন এবং তিনি এখন অনুতপ্ত ও বাড়ি ফেরার কথাই ভাবছিলেন ৷
(অর্থাৎ সত্য কথা বলার মতো অকুতোভয়ী তিনি ছিলেন না, আর সেই দয়ানন্দই যদি লেখেন ‘সত্যার্থ-প্রকাশ’ তাতে কতটা মিথ্যা থাকতে পারে তা একবার ভেবে দেখুন)



দয়ানন্দের প্রতি তার পিতার কোন আস্থা-বিশ্বাস ছিলনা, কেননা বিশ্বাস করার যোগ্য সন্তান তিনি জন্ম দেন নাই ৷ তাই তিনি দয়ানন্দকে নজরে রাখার জন্য দয়ানন্দের সাথে সিপাহী নিযুক্ত করে দিলেন ৷ এদিকে দয়ানন্দ আবার পালানোর কৌশল খুজতে লাগল ৷ একদিন রাতে দয়ানন্দ ঘুমানোর ভান করে শুয়ে আছেন, সিপাহীরা ভাবল দয়ানন্দ ঘুমিয়ে পরেছে ৷ তাই তারাও ঘুমাতে গেল ৷ এই সুযোগে সিপাহীদের ধোকা দিয়ে তিনি আবার বাড়ি হতে পলায়ন করলো ৷
(সত্যার্থ-প্রকাশ গ্রন্থেও তিনি শাস্ত্রবাক্য নিয়ে ধোকাবাজী করেছেন, কিন্তু দয়ানন্দ অনুরাগীরা তা বুঝতে পারে না)

এরপর তিনি বিভিন্ন স্থানে ঘুরতে থাকেন, তো দয়ানন্দ মহাশয় যখন চন্ডালগড়ে অবস্থান করছিলেন তখন তিনি সিদ্ধিপানে অভ্যস্ত হয়েছিলেন ৷ একদিন তিনি চন্ডালগড়ের একটি শিবমন্দিরে রাত যাপনের উদ্দেশ্য উপস্থিত হলেন ৷ সিদ্ধির নেশার ঘোরে তিনি মন্দিরে গভীর নিদ্রায় ডুবে গেলেন ৷ তিনি তখন একটি স্বপ্ন দেখলেন ৷ কি স্বপ্ন জানেন? স্বপ্ন দেখলেন যে, মহাদেব ও পার্বতী দয়ানন্দের বিবাহ নিয়ে আলোচনা করছেন 😁 ৷
(পাঠক লক্ষ্য করুন, দয়ানন্দ কলির প্রভাবে পরে মূর্তিপূজা খন্ডন করার চেষ্টা করেছে আজীবন, আর যখন প্রয়োজন পরেছে তখন কিনা নিজেই মন্দিরের আশ্রয় নিয়েছে? এ কেমন দ্বিচারিতা? এ কেমন শঠতা?)


শুধু সিদ্ধি বা গাঁজাই তিনি টানেনি, তিনি হুকোও টেনেছিলেন খুব ৷ হুকো তার খুব প্রিয় ছিল ৷

দয়ানন্দ সরস্বতী মূর্তিপূজার প্রতি অবিশ্বাসী ছিলেন, ঈশ্বরের অবতার মানতেন না, শিব-রাম-কৃষ্ণকে কেবল সাধারণ মানুষ মনে করতেন  ৷ তিনি এসকল বিষয়ে যখন বিভিন্নস্থানে ভাষণ দিতেন তখন শ্রোতারা তার ভাষণ শুনে ইট-পাটকেল-জুতো ছুড়ে মারত ৷



তো শেষমেশ স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী কি উপাধি অর্জন করেছিল জানেন? তার উপাধি ছিল ‘কোলাহল-স্বামী’ ৷ কারণ যেখানেই যেতেন তিনি নিজেই কোলাহল জুড়ে দিতেন এবং বিরোধীপক্ষের যুক্তিতে না পেরে দিলে তাদের যুক্তিকে তিনি স্বয়ং কোলাহল আখ্যা দিতেন ৷


তার জীবনের শেষ পরিণিতি খুবই কষ্টদায়ক ছিলো ৷ তিনি বেগম নান্নিজান নামক এক মুসলিম মহিলার হাতে বিষ খেয়ে বহুদিন যাবৎ ভুগতে ভুগতে মারা যান ৷ ঈশ্বর কেন তাকে এমন যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু দিলেন?




[যে দুটি বইয়ের তথ্য বিশ্লেষণ করে পোস্টটি লেখা হয়েছে—
   i) দয়ানন্দ-চরিত, শ্রীদেবেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়
   ii) Life &Teachings Of Swami Dayananda by Vishwa Prakash]

==============================
আপডেটঃ শ্রীদেবেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় প্রণীত ‘দয়ানন্দচরিত’ গ্রন্থে (পৃষ্ঠাঃ ৫৬, ৭৭) আর্যসমাজের ধর্মগুরু স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতীর সিদ্ধি পান বা গঞ্জিকা সেবনের উল্লেখ পাওয়া যায় ৷ এই তথ্য যখন দয়ানন্দপ্রেমী আর্যসমাজীদের সম্মুখে উপস্থাপন করা হয় তখন তারা গুরুর দোষ ঢাকতে গিয়ে বলে দয়ানন্দের তখন বৈদিক দীক্ষা হয়নি, তার সন্ন্যাস গ্রহণ হয়নি, তখন দয়ানন্দ অল্পবুদ্ধি বালকমাত্র ছিল ইত্যাদি ইত্যাদি ৷ এসব সম্পূর্ণ মিথ্যাচার মাত্র ৷ দয়ানন্দ সন্ন্যাস গ্রহণের পরই খাঁজা টেনেছিল ৷ দয়ানন্দের বয়স যখন তেইশ কিংবা চব্বিশ বছর তখন তিনি চানোদ-কল্যানী নামক স্থানের অদূরস্থিত পূর্ণানন্দ স্বামীর নিকট দীক্ষা গ্রহণপূর্বক সন্ন্যাসাশ্রমে প্রবিষ্ট হন ৷ তারপর সেখান হতে নানা স্থানে ভ্রমণ করে হরিদ্বারের কুম্ভমেলায় যান ৷ হরিদ্বার হতে বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণপূর্বক শেষমেশ চন্ডালগড়ে এসে খাঁজা টানার অবকাশ পান ৷
 এরপর দয়ানন্দপ্রেমীগণ তাদের গুরুর দোষ ঢাকতে গিয়ে বলে যে- ওসব সঙ্গদোষে হয়েছে ৷ অর্থাৎ যত দোষ নন্দঘোষ!!
তা গাঁজা না হয় সঙ্গদোষে টেনেছিল কিন্তু দয়ানন্দ তার পরিণত বয়সেও হুকো টানত কোন দোষে? শাক দিয়ে মাছ আর কত ঢাকবেন? আর্যসমাজ নয়াবাস দিল্লী হতে প্রকাশিত ‘মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী কা জীবন চরিত্র’ নামক হিন্দী গ্রন্থের ৩০২ পৃষ্ঠায় দয়ানন্দের মৃত্যুর ছয় বছর পূর্বেও তার হুকো টানার নির্দশন পাওয়া যায় ৷ এছাড়া উক্ত বইয়ের ৯১১ পৃষ্ঠায় লিখিত আছে যে, দয়ানন্দ ভোজন শেষে পান খেতেন ৷ 😊 ৷
জয় জয় দয়ানন্দ সরস্বতীর জয়!


বৃহস্পতিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০১৭

ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অন্তর্ধান লীলা


কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ শেষে শোকসন্তপ্তা গান্ধারী শ্রীকৃষ্ণকে কম্বোজরাজ, মগধরাজ জয়ৎসেন, রুচিরাঙ্গদধারী কেকয় দেশীয় পাঁচ ভ্রাতা, পাঞ্চালরাজ দ্রুপদ, চেদিদেশাধিপতি মহাবীর ধৃষ্টকেতু প্রভৃতির মৃতদেহ এবং মৃতদেহের পার্শ্বে  তাহাদের রমণীগণ ও আত্মীয়-স্বজন কিরুপ শোক করিতেছে সে দৃশ্য দেখাইয়া অনেক বিলাপ করিলেন ৷ গান্ধারী বহুবিধ বিলাপ করিয়া (বাকি অংশ কালীপ্রসন্ন সিংহের অনুবাদ হতে সরাসরি উদ্ধৃত—) দুঃখশোকে একান্ত অধীর ও হতজ্ঞান হইয়া ভূতলে নিপতিত হইলেন এবং কিয়ৎক্ষণ পরে ক্রোধভরে বাসুদেবের প্রতি দোষারোপ করিয়া কহিলেন, “জনার্দ্দন! যখন কৌরব ও পাণ্ডবগণ পরস্পরের ক্রোধানলে পরস্পর দগ্ধ হয়, তৎকালে তুমি কি নিমিত্ত তদ্বিষয়ে উপেক্ষা প্রদর্শন করিলে? তোমার বহুসংখ্যক ভৃত্য ও সৈন্য বিদ্যমান আছে; তুমি শাস্ত্রজ্ঞানসম্পন্ন, বাক্যবিশারদ ও অসাধারণ বলবীর্য্যশালী, তথাপি ইচ্ছা পূর্ব্বক কৌরবগণের বিনাশে উপেক্ষা প্রদর্শন করিয়াছ। অতএব তোমারে অবশ্যই ইহার ফলভোগ করিতে হইবে। আমি পতিশুশ্রূষা দ্বারা যে কিছু তপঃসঞ্চয় করিয়াছি, সেই নিতান্ত দুর্লভ তপঃপ্রভাবে তোমারে অভিশাপ প্রদান করিতেছি যে, তুমি যেমন কৌরব ও পাণ্ডবগণের জ্ঞাতি বিনাশে উপেক্ষা প্রদর্শন করিয়াছ, তেমনি তোমার আপনার জ্ঞাতিবর্গও তোমা কর্ত্তৃক বিনষ্ট হইবে। অতঃপর ষট্‌ত্রিংশৎ বর্ষ সমুপস্থিত হইলে তুমি অমাত্য, জ্ঞাতি ও পুত্ত্রহীন এবং বনচারী হইয়া অতি কুৎসিত উপায় দ্বারা নিহত হইবে। তোমার কুলরমণীগণও ভরতবংশীয় মহিলাগণের ন্যায় পুত্ত্রহীন ও বন্ধুবান্ধব বিহীন হইয়া বিলাপ ও পরিতাপ করিবে।”

তখন মহামতি বাসুদেব গান্ধারীর মুখে এই কথা শ্রবণ করিয়া হাস্যমুখে তাঁহারে কহিলেন, “দেবি! আমা ব্যতিরেকে যদুবংশীয়দিগকে বিনাশ করে, এমন আর কেহই নাই। আমি যে যদুবংশ ধ্বংস করিব, তাহা বহুদিন অবধারণ করিয়া রাখিয়াছি। আমার যাহা অবশ্য কর্ত্তব্য, এক্ষণে আপনি তাহাই কহিলেন। যাদবেরা মনুষ্য বা দেব দানবগণের বধ্য নহে; সুতরাং তাঁহারা পরস্পর বিনষ্ট হইবেন।” বাসুদেব এই কথা কহিবামাত্র পাণ্ডবেরা ভীত ও উদ্বিগ্ন হইয়া প্রাণ ধারণ বিষয়ে এককালে হতাশ হইলেন।
(স্ত্রীপর্ব, স্ত্রীবিলাপপর্ব্বাধ্যায়)


এরপর, যদুবংশের বিনাশ আরম্ভ হইলে, মহাত্মা বলরাম অন্তর্ধান হইলেন ৷ “তখন সর্ব্বজ্ঞ দিব্যচক্ষু ভগবান্ বাসুদেব জ্যেষ্টভ্রাতা দেহত্যাগ করিলেন বিবেচনা করিয়া চিন্তাকুলিতচিত্তে সেই বিজন পথে পরিভ্রমণ করিতে করিতে ভূতলে উপবেশন করিলেন। ঐ সময় পূর্ব্বে গান্ধারী তাঁহাকে যাহা কহিয়াছিলেন এবং তিনি উচ্ছিষ্ট পায়স পদতলে লিপ্ত না করাতে দুর্ব্বাসা যে সমুদায় বাক্য প্রয়োগ করিয়াছিলেন, সেই সমুদায় তাঁহার স্মৃতিপথে সমুদিত হইল। তখন তিনি নারদ, দুর্ব্বাসা ও কণ্বের বাক্য প্রতিপালন, তাঁহার স্বর্গগমনবিষয়ে দেবতাদিগের সন্দেহভঞ্জন ও ত্রিলোকপালন করিবার নিমিত্ত তাঁহাকে মর্ত্ত্যলোক পরিত্যাগ করিতে হইবে, বিবেচনা করিয়া ইন্দ্রিয়সংযম ও মহাযোগ অবলম্বন পূর্ব্বক ভূতলে শয়ন করিলেন। ঐ সময় জরানামক ব্যাধ মৃগবিনাশবাসনায় সেই স্থানে সমাগত হইয়া দূর হইতে যোগাসনে শয়ান কেশবকে অবলোকন পূর্ব্বক মৃগ জ্ঞান করিয়া, তাঁহার প্রতি শর নিক্ষেপ করিল।
ঐ শর নিক্ষিপ্ত হইবামাত্র উহা দ্বারা হৃষীকেশের পদতল বিদ্ধ হইল। তখন সেই ব্যাধ মৃগগ্রহণবাসনায় সত্বরে তথায় উপস্থিত হইয়া দেখিল, এক অনেকবাহুসম্পন্ন পীতাম্বরধারী যোগাসনে শয়ান পুরুষ তাহার শরে বিদ্ধ হইয়াছেন। লুব্ধক তাঁহাকে দর্শন করিবামাত্র আপনাকে অপরাধী বিবেচনা করিয়া, শঙ্কিতমনে তাঁহার চরণে নিপতিত হইল। তখন মহাত্মা মধুসূদন তাহাকে আশ্বাস প্রদান পূর্ব্বক অচিরাৎ আকাশমণ্ডল উদ্ভাসিত করিয়া স্বর্গে গমন করিলেন।
[[শ্রীকৃষ্ণ কি বলে ব্যাধকে আশ্বস্ত করেছিলেন তা ব্যাসদেব মহাভারতে লিখেন নাই, কিন্তু পরবর্তীতে ভাগবতে লেখেন— ভগবান্ শ্রীকৃষ্ণ তখন সেই ব্যাধকে সম্বোধনপূর্বক বলিলেন, “ওহে জরা! তোমার ভয় নাই ৷ এ সমস্ত আমারই ইচ্ছায় ঘটিয়াছে; ইহাতে তোমার কোন অপরাধ নাই ৷ অতএব পুণ্যবান ব্যক্তিগণ বহু সৎকর্মের ফলে যে স্বর্গলোকে গমন করিয়া থাকেন, তুমি আমার অনুগ্রহে সেই সুরপুরীতে গমন কর ৷” (শ্রীমদ্ভাগবত, ১১/৩০/৩৯) ]]
ঐ সময় ইন্দ্র, অশ্বিনীকুমারদ্বয় এবং রুদ্র, আদিত্য, বসু, বিশ্বদেব, মুনি, সিদ্ধ, গন্ধর্ব্ব ও অপ্সরোগণ তাঁহার প্রত্যুদ্গমনার্থ নির্গত হইলেন; তখন ভগবান্ নারায়ণ তাঁহাদের কর্ত্তৃক সৎকৃত হইয়া তাঁহাদের সহিত স্বীয় অপ্রমেয় স্থানে সমুপস্থিত হইলেন। দেবতা, মহর্ষি, সিদ্ধ, চারণ, গন্ধর্ব্ব, অপ্সরা ও সাধ্যগণ তাঁহার যথোচিত পূজা করিতে লাগিলেন; মুনিগণ ঋগ্বেদপাঠ ও গন্ধর্ব্বগণ সংগীত দ্বারা তাঁহার স্তব করিতে আরম্ভ করিলেন এবং দেবরাজ ইন্দ্র আহ্লাদিতচিত্তে তাঁহার অভিনন্দনে প্রবৃত্ত হইলেন।” (মৌসলপর্ব, অধ্যায়-৪)


শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে পূর্বেই খবর পাঠিয়েছিলেন ৷ অর্জুন সংবাদ পেয়ে সেখানে এসে কৃষ্ণের পিতা বসুদেবের সাথে সাক্ষাৎ করেন ৷ শোকাকুল বসুদেব অর্জুনের কাছে বহু বিলাপ করেন ৷ তিনি অর্জুনকে বলেন, “তুমি, দেবর্ষি নারদ ও অন্যান্য মহর্ষিগণ যাহারে সনাতন দেবদেব বলিয়া কীর্ত্তণ করিয়া থাক, তিনি এক্ষণে স্বচক্ষে জ্ঞাতিবধ প্রতক্ষ্য করিয়া উপেক্ষা করিলেন ৷ বোধহয়, গান্ধারী ও ঋষিগণের বাক্য অন্যথা করিতে তাঁহার বাসনা হয় নাই ৷ তোমার পৌত্র পরীক্ষিৎ অশ্বথামার ব্রহ্মাস্ত্র দ্বারা দগ্ধ হইলে, তিনিই তাহার জীবনদান করিয়াছিলেন, কিন্তু এক্ষণে স্বীয় পরিজনদিগকে রক্ষা করিতে তাঁহার বাসনা হইল না ৷” (মৌসলপর্ব, অধ্যায়-৬)

পরে ব্যাসদেব অর্জুনকে বলেছিলেনঃ “বৃষ্ণি ও অন্ধকবংশীয় মহারথগণ ব্রহ্মশাপে দগ্ধ হইয়াছে; অতএব তাহাদিগের নিমিত্ত তোমার শোক করা কর্তব্য নহে ৷ ঐ বীরগণের নিধন অবশ্যম্ভাবী বলিয়া মহাত্মা বাসুদেব উহা নিবারণে সমর্থ হইয়াও নিবারণে উপেক্ষা করিয়াছেন ৷ তিনি মনে করিলে মহর্ষিশাপখন্ডের কথা দূরে থাকুক, এই স্থাবর-জঙ্গমাত্মক বিশ্বসংসারকেও অন্যরুপ নির্মাণ করিতে পারেন ৷ সেই পতিতপাবন কেবল পৃথিবীর ভারাবতরণ করিবার নিমিত্তই বসুদেবের গৃহে উৎপন্ন হইয়াছিলেন ৷” (মৌসলপর্ব, অধ্যায়-৮)



                     (তথ্যসূত্রঃ মহাভারত, কালীপ্রসন্ন সিংহ অনুদিত)

বুধবার, ২২ নভেম্বর, ২০১৭

কুমারিল ভট্ট


বেদজ্ঞানী সেনাপতিরাই আমাদের ধর্ম রক্ষাকারী ৷ কোন যোদ্ধার তরবারি নয়, বৈদিক মন্ত্রই আমাদের রক্ষাকবচ ।
আজ তেমনি এক বৈদিক সেনানায়কের কথা আপনাদের কাছে তুলে ধরবো যার নাম ‘কুমারিল ভট্ট’।

কুমারিল ভট্টের জন্ম ৭০০ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে, তিনি দক্ষিণ ভারতীয় ব্রাহ্মণ ছিলেন । তাঁর জন্মস্থান চোলদেশে । তাঁর আবির্ভাব কালে সমগ্র ভারত বৌদ্ধ এবং জৈন ধর্মের কদর্য ধর্মাচারে আক্রান্ত ছিল। ভারতে বৈদিকধর্মের পুনঃপ্রতিষ্ঠাকালে উনি ছিলেন প্রধান সেনাপতি। কুমারিল বৌদ্ধ জৈন প্রভৃতি ভারতের যাবতীয় অবৈদিক ধর্মাবলম্বিগণকে বিচারে পরাজিত করে বৈদিকধর্মের কর্মকাণ্ডের পুণঃপ্রতিষ্ঠা করেন। বৌদ্ধ, জৈনরা যেমন বেদবিরোধী ছিল, উনি তেমনি বেদানুরাগী, বৌদ্ধরা যেমন বেদ ছেদনকারী, ইনি তেমনি বেদ প্রতিষ্ঠাকারী।

কুমারিল ভট্ট শৈশব থেকেই বেদানুরাগী ছিলেন এবং পরে একজন বেদজ্ঞ পণ্ডিত হয়ে ওঠেন ।
কুমারিল ছিলেন প্রসিদ্ধ বৌদ্ধ পণ্ডিত ধর্মকীর্তির কাকা। ধর্মকীর্তি ১৮ বছর বয়সের মধ্যে বেদ বেদাঙ্গ ব্যাকরণ সর্বশাস্ত্রপারগামী হন। ধর্মকীর্তি শাস্ত্রজ্ঞানের জন্য কুমারিলেরর শিষ্য হন। কিন্তু বৌদ্ধধর্মে আকৃষ্ট হয়ে মগধদেশীয় প্রসিদ্ধ বৌদ্ধগুরু ধর্মপালের শিষ্য হন। এই ধর্মপালের কাছে বৌদ্ধমত শিক্ষা নিয়ে দেশে ফিরে ধর্মকীর্তি কুমারিলকে বিচারে পারাজিত করে আর অন্ধ স্নেহে কুমারিলও তার পরাজয় স্বীকার করে এবং পণ-অনুসারে বৌদ্ধ হতে বাধ্য হন।
ফলতঃ নালন্দা এসে ধর্মপালের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। বৌদ্ধ ন্যায়শাস্ত্র শিক্ষা করতে থাকেন কিন্তু কুমারিল অন্তরে বৈদিক থেকে যান। একদিন বৌদ্ধগুরু সভামধ্যে শাস্ত্রব্যাখ্যা করেছিলেন। বহু শ্রোতাদর্শক এবং কুমারিল এবং অন্যান্য শিষ্য সেই উপস্থিত ছিলেন। বৌদ্ধ গুরু শাস্ত্রব্যাখ্যা করতে করতে ভীষণভাবে বেদের নিন্দা করতে লাগলো, কুমারিল পক্ষে অসহ্য লাগতে লাগলো এই বেদ নিন্দা। তিনি নীরবে অশ্রু বিসর্জন করতে লাগলেন। অন্যান্য ভিক্ষু এবং গুরু বিরক্ত হয়ে কুমারিল কে বলেন, “আপনার ক্রন্দনের কারন কি?? মনে হচ্ছে আপনার বেদের উপর শ্রদ্ধা এখনও যায় নি এবং আপনি ভান করে বৌদ্ধ সেজে আমাদের বিদ্যা গ্রহণ করছেন।”
কুমারিল গুরুবাক্যে মর্মাহত হয়ে উত্তেজিত হয়ে বিনীতভাবে বললেন, “আপনি বেদবিষয়ে অযথা নিন্দা করছেন এটাই আমার রোদনের হেতু।”
এতে গুরু আরো রুষ্ট হলেন কুমারিরকে তর্কে আহ্বান করলেন ক্রমে গুরুর সঙ্গে কুমারিল বেদের প্রামাণ্য নিয়ে ভীষণ বিচার আরাম্ভ হলো। বহুক্ষণ বিচারের পর বৌদ্ধ গুরু কুমারিলের যুক্তিশরে জর্জরিত হতে লাগলেন। শেষে কুমারিল বললেন “সর্বজ্ঞের উপদেশ ভিন্ন জীব সর্বজ্ঞ হইতেই পারে না। বুদ্ধ বেদজ্ঞানে জ্ঞানী হইয়া বেদ মানেন নাই— ইহা তাহার চৌর্য ভিন্ন আর কি?” এই শুনে বৌদ্ধগুরু ক্রুদ্ধ হয়ে বলেন, “তোমায় এই উচ্চ প্রাসাদ হইতে ফেলিয়া দিয়ে প্রাণবধ করা উচিত ৷” গুরুর কথা শুনে আগের থেকে উত্তেজিত বৌদ্ধ শিষ্যরা কুমারিল কে বলপূর্বক উঁচু প্রাসাদ থেকে ফেলে দিলেন। পতনকালে কুমারিল উচ্চৈঃস্বরে বললেন, “বেদ যদি প্রমাণ হয়, তাহা হইলে আমি যেন অক্ষত শরীরে জীবিত থাকি ৷”
মাটিতে পরেও কুমারিল প্রাণ গেলোনা এমনকি বিশেষ আঘাতো পেলেননা। বৌদ্বরা এই দেখে একেবারে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন । কুমারিল তখন বললেন, “ওহে অহিংসাপরায়ণ বৌদ্ধগণ! আমি দেখিতেছি আমার একটি চক্ষুতে একটুমাত্র আঘাত লাগিয়াছে। আমার এ ক্ষতিও হইত না, যদি আমি ‘বেদ যদি প্রমাণ হয়’ এইরূপ সংশয়াত্মক বাক্যপ্রয়োগ না করিতাম ৷” বৌদ্ধগণ তখন কুমারিল দৈবশক্তি দেখে পালিয়ে গেলো এবং চিন্তিত ও শঙ্কিত হয়ে পরলেন । পরবর্তীকালে বৌদ্বরা এক বিরাট বিচারের ব্যাবস্থা করলেন। দেশবিদেশ থেকে বৈদিক এবং বৌদ্ধ পণ্ডিতরা সেখানে উপস্থিত হলেন। দেশের রাজাদের সামনে বৌদ্ধগুরু এই পণ রাখলেন বিজেতার মত গ্রহণ অথবা তুষানলে প্রাণত্যাগ উভয় পক্ষ এই পণে সম্মত হলেন। এই তর্কসভায় কুমারিলর ভ্রাতুষ্পুত্র ধর্মকীর্তিও উপস্থিত ছিলেন। বৌদ্ধরা যথাসাধ্য চেষ্টার পরেও কুমারিল কাছে হার স্বীকার করলো। তখন বৌদ্ধ গুরু বললেন, “আমি বিচারে পরাজিত হইয়াছি বটে, কিন্তু আমি বেদকে স্বীকার করবো না, যাহা হউক আমি ভগবান বুদ্ধের মত ত্যাগ করিব না, প্রাণত্যাগ আমি বরং করিলাম ৷” তুষানলে সর্বসমক্ষে প্রাণ ত্যাগ করলেন।

এরপর কুমারিল জৈনগণকে পরাস্ত করে দক্ষিণ বিজয় করেন ৷ এসময় বহু জৈন বৈদিকধর্মে ফিরে আসে ৷ কুমারিল কেবল দ্বিগবিজয় করেই ক্ষান্ত হননি, তিনি বৈদিক যাগ-যজ্ঞাদির ফল প্রদর্শন করে সকলকে বৈদিকধর্মের প্রতি শ্রদ্ধালু করতেন ৷ তার প্রচেষ্ঠাতেই তখন বেদ-বেদান্তের পঠনপাঠন পুণরায় আরম্ভ হয় ৷ নতুবা বৌদ্ধ ও জৈনগণ যেরুপে বৈদিকগ্রন্থাদি ভস্মাৎ করেছিল এবং যেভাবে রাজশক্তিবলে নিজ নিজ মত প্রতিষ্ঠা করেছিল তাতে আর বৈদিকধর্মের পুণঃপ্রতিষ্ঠার আশা ছিল না ৷


(শঙ্করাচার্য ও কুমারিল ভট্ট)


                   Related post : শঙ্করাচার্য ও বেদান্ত-দর্শন


শুক্রবার, ৩ নভেম্বর, ২০১৭

কৃষ্ণপ্রিয়া মীরা : পর্ব-৩


=======================

ঊদাবাঈ এর প‌রিবর্তন

=======================

বিক্রম‌জিৎ রাণা ছি‌লেন ক‌ঠোর প্রকৃ‌তির ও স্থূল অনুভূ‌তি সম্পন্ন মানুষ। তি‌নি স্থির কর‌লেন অবাধ্য মীরার প্র‌তি কড়া নজর রাখা প্র‌য়োজন, এবং সে কা‌জে অপর কাউ‌কে বিশ্বাস‌যোগ্য ম‌নে না হওয়ায় আপন ভ‌গিনী ঊদাবাঈ‌কে নিযুক্ত কর‌লেন । তাছাড়াও আ‌রো তিন নীরা প্রহরী সর্বক্ষণ পাহারা দেওয়ার জন্য মোতা‌য়েন করা হ‌লো । ঊদাবাঈ মীরার মন প‌রিবর্তনের জন্য সর্ব‌তোভা‌বে স‌চেষ্ট হ‌লেন । ঊদাবাঈ- এর স‌ঙ্গে মীরার কথোপকথ‌নের এক চমকপ্রদ বিবরণ লোকমু‌খে প্র‌চলিত আ‌ছে, যা‌তে মীরার অপা‌র্থিব দৃ‌ষ্টিভ‌ঙ্গি ও নির্ভীক চ‌রি‌ত্রের কিছু প‌রিচয় পাওয়া যায় ।

ঊদা => মীরা তু‌মি সাধুসঙ্গ ত্যাগ কর । রাজ্যময় তোমার না‌মে হাজা‌রো নিন্দা।
মীরা => তা‌তে আমার কি ? ও‌দের নিন্দা রটা‌তে দাও । আ‌মি সাধু‌দের ভক্ত ।
ঊদা => তু‌মি মু‌ক্তোর মালা গলায় দাও না, বহুমূল্য অলঙ্কার সে সবও ব্যবহার কর না, কেন ?
মীরা => সে সব ভাই, আ‌মি বিদায় ক‌রে‌ছি । সৎ চিন্তা ও স‌ন্তোষই আমার ভূষণ ।
ঊদা => অন্য সবখা‌নে কত রঙচ‌ঙে শোভাযাত্রা, নারী-প‌ুরু‌ষের কত জমাট মজ‌লিশ, আর তোমার এখা‌নে যত সাধু-ভক্তের মেলা ।
মীরা => দেখ দেখ, বা‌ড়ির ছা‌দে উ‌ঠে, সাধুর শোভা! কি চমৎকার না দেখা‌চ্ছে!
ঊদা => চি‌তো‌রের সকল মানুষ আজ তোমার জন্য ল‌জ্জিত । মহারাণার মাথা লজ্জায় হেঁট!
মীরা => চি‌তোর আজ মুক্ত হ‌য়ে‌ছে, আর রাণার পথও মুক্ত ।
ঊদা => তোমার মা-বাবা তোমার আচর‌ণে ল‌জ্জিত, তোমার জন্মস্থানও কল‌ঙ্কিত ।
মীরা => ধন্য আমার মা-বাবা । ধন্য আমার জন্মভূ‌মি ।
ঊদা => রাণা তোমার উপর ক্ষুব্ধ । তোমার জন্য তি‌নি রত্নখ‌চিত পা‌ত্রে বিষ তৈরি রে‌খে‌ছেন ।
মীরা => বেশ তো বোন, আ‌মি তা প্রভুর চরণামৃত ব‌লে পান করব ।
ঊদা => যে সে বিষ নয় তা । অ‌তি ভয়ানক, তা দেখা মাত্রই তুুমি মারা পড়‌বে ।
মীরা => এ জগ‌তে আমার তো কেউ নেই । মা বসুন্ধরা কোল পে‌তে আমায় গ্রহণ কর‌বেন ।
ঊদা => রাণাজী জান‌তে চান, স‌তি ক‌রে বল তো তোম‌ার পথ কি?
মীরা => ক্ষু‌ধের ধার আম‌ার পথ । মহারাণ‌ার সাধ্য কি সেখা‌নে পৌঁছান?
ঊদা => রাণার অবাধ্য হ‌য়ো না, মীর‌া । তাঁর কথা শোন । তিনি ক্রুদ্ধ হ‌লে জগ‌তে আর কোথাও তোম‌ার স্থান নেই জে‌নো ।
মীরা => গি‌রিধারীলাল আমার আশ্রয়, ঊদা । কায়-ম‌নো-বাক্যে আমি তাঁরই শরণাগত ।

এভাবে ঊদাবাঈয়ের সকল চেষ্টা মীন‌াবাঈ‌য়ের ম‌নের প‌রিবর্তন ঘটা‌তে ব্যর্থ হ‌লো । মীরা তাঁর নিজের জগ‌তে বিচরণ কর‌তে থাক‌লেন, ইহজগতের ভয়, প্র‌লোভন কোন কিছুই তাঁর ম‌নে প্রভ‌াব বিস্তার কর‌তে সক্ষম হলো না ।
অবশ্য পরিবর্তন ঘ‌টে‌ছিল ত‌বে তা মীরার নয় ঊদাবাঈ‌য়ের । স্পর্শম‌ণির ছোঁয়ায় লোহা সোনায় রূপা‌ন্ত‌রিত হ‌লো । ঊদার উপর বিক্রম‌জি‌তের ভরসা ছিল য‌থেষ্ট, কারণ তাঁর ধারণ‌া সে তাঁর একান্ত অনুগত ভক্ত । কিন্তু সাধুসঙ্গ অ‌তি বিস্ফোরক বস্তু । এক‌দিন জগৎ ভু‌লে, একমাত্র তাঁর দ‌য়ি‌তের চিন্ত‌ায় মগ্ন হ‌য়ে, ভাবে বি‌ভোর মীরা গাই‌ছি‌লেনঃ

“ত্যা‌জে‌ছি সকল লজ্জা, স‌খি, ত্যা‌জে‌ছি কুল-মান
য‌বে পে‌য়ে‌ছি আমার শ্যাম ।
ভু‌লে‌ছি সক‌ল সুখ
আমার টুটু‌ছে বন্ধন ভয় ।
আহা! কি বা শোভা তাঁর শিরে শিখী-পাখা
ললাটে তিলক‌রেখা,
ত্রিভুবনে কে বা পা‌রে ভু‌লিতে
ঐ ভুবন মোহন সাজ ?
চিকন যুগল গ‌ণ্ডে তাঁর কর্ণকুণ্ডল ছায়া
সুনীল সায়‌রে সঞ্চরে যথা
ক্রীড়াচঞ্চল মীন,
ব‌ঙ্কিম ভ্রূ, চপল নয়ন–
লজ্জা পায় খঞ্জনার রূপ অ‌ভিমান ।
সুচারু তাঁর তীক্ষ্ম নাসা, নয়ন ভু‌লা‌নো বেশ
রক্ত‌গোলাপ ও‌ষ্ঠে শো‌ভে মধুর হাস্য রেস ।
সুষ্ঠু শোভন দ‌ন্তে বিছু‌রে
শুভ্র আ‌লোক রা‌শি,
বিজলী চমকে আভর‌ণে তাঁর
আ‌লোর পরশ লা‌গি ।
তনু-মন-প্রাণ মীরা ক‌রিয়া‌ছে দান
ঐ অপরূপ রূপ হে‌রি! ”

মীরার হৃদয় উৎসা‌রিত সেই গা‌নের মাধুর্য ঊদাবাঈ‌য়ের প্রা‌ণে ঘটাতে থা‌কে প্রবল বি‌ক্রিয়া, তার অন্তর্জগ‌তে ঘ‌টে পরিবর্তন, মীরার পদত‌লে নতজানু হ‌য়ে ভিক্ষা ক‌রে তাঁর শিষ্যত্ব । ঊদার পক্ষে অতঃপর শুরু হ‌লো ভিন্ন প্রকার রা‌ত্রি জাগরণ । তার যে পরিবর্তন ঘ‌টে‌ছিল তা ছিল তাৎক্ষণিক । এখন সে গি‌রিধ‌রের সাক্ষাৎ দর্শনলা‌ভের জন্য প্রবল আকাঙ্ক্ষা বোধ কর‌তে থাকল এবং যা‌তে তি‌নি দর্শন দেন তার জন্য মীরার নিকট কাতর প্রার্থনা করল ।
মীরা স্বভাবতই ছি‌লেন উদার প্রকৃ‌তির । ঊদার ব্যাকুলতা তাঁ‌কে গভীরভাবে স্পর্শ করল এবং তিনি ঊদাবাঈ‌য়ের আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করার জন্য গি‌রিধ‌রের নিকট আকুল প্রার্থনা জানা‌লেন । তখন মধ্যরা‌ত্রি । ঊদা ও তার অপর তিন স‌ঙ্গিনী- মিথুলা, চম্পা, চা‌মেলী ম‌ন্দি‌রে বসে আ‌সে । মীরা ত‌াঁর মধুর কিন্নরী ক‌ন্ঠে এ‌কের পর এক ভজন গে‌য়ে চল‌ছেন । হঠাৎ সক‌লের বিস্মিত দৃ‌ষ্টির সম্মু‌খে স্বয়ং গি‌রিধারীলা‌লের দিব্য আ‌বির্ভ‌াব । তি‌নি জিজ্ঞাসা কর‌লেন - “মীরা, আজ রা‌তে তু‌মি কেন এত যন্ত্রণা কাতর?”

সাধুস‌ঙ্গে এমন ক‌রেই অসম্ভবও সম্ভব হয় ৷ এর ফ‌লে কেবলমাত্র ঊদাই নয়, অপর তিনজন যারা আ‌দৌ বি‌শেষ আগ্রহী ছিল না, তা‌দেরও ঈশ্বন দর্শন হ‌লো ।



সাম্প্রতিক পোস্ট

পুরুষ—কৃষ্ণ ৷৷ প্রকৃতি—রাধা

 পুরুষ—কৃষ্ণ ৷৷ প্রকৃতি—রাধা ======================= যোগেনাত্মা সৃষ্টিবিধৌ দ্বিধারূপো বভূব সঃ ৷ পুমাংশ্চ দক্ষিণার্ধাঙ্গো বামাঙ্গঃ প্রকৃতিঃস্...

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ