বুধবার, ১৪ মার্চ, ২০১৮

হরেকৃষ্ণ মহানাম মন্ত্র - কোন শাস্ত্রে আছে?


হরেকৃষ্ণ মাহানাম মন্ত্রটি প্রথমত পাওয়া যায় কৃষ্ণযজুর্বেদীয় কলি-সন্তরণ উপনিষদে ৷ সেখানে এইভাবে আছে—
“হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে ৷
হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে ৷৷”
এই উপনিষদে বলা হয়েছে যে, এই ষোল নাম (words) তথা বত্রিশ অক্ষর জপের মাধ্যমে কলির প্রভাব হতে মুক্ত হয়ে মোক্ষলাভ করা সম্ভব ৷

.
এরপর, রাধা-তন্ত্রে (২/৯) মহানাম মন্ত্রটি এইভাবে আছে—
“হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে ৷
                হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে ৷৷”

.
বৃহন্নারদীয় পুরাণে (৩/৮/১২৬) বলা হয়েছে—
হরের্নাম হরের্নাম হরের্নামৈব কেবলম্ ।
কলৌ নাস্ত্যেব নাস্ত্যেব নাস্ত্যেব গতিরন্যথা ।।
অর্থ— হরিনাম হরিনাম হরিনাম কেবল, কলিযুগে ইহা বিনা গতি নাই নাই নাই ৷
.
মহাভারতে (শান্তিপর্ব ২০৪/৭৭) ভীষ্মদেব রাজা যুধিষ্ঠিরকে উপদেশ দিয়েছেন—
“ভজস্বৈনং বিশালাক্ষং জপন্ কৃষ্ণেতি সত্তম ৷৷”
অর্থাৎ—তুমি কৃষ্ণনাম জপ করিতে থাকিয়া এই বিশালনয়ন কৃষ্ণের সেবা করো৷

(মহাভারত, হরিদাশ সিদ্ধান্তবাগীশ)

.
শ্রীভগবান গীতায় (৯/১৪) বলেছেন—
সততং কীর্তয়ন্তো মাং যতন্তশ্চ দৃঢ়ব্রতাঃ।
নমস্যন্তশ্চ মাং ভক্ত্যা নিত্যযুক্তা উপাসতে।।
“তাঁহারা (সাত্ত্বিকী প্রকৃতি-প্রাপ্ত মহাত্মগণ) যত্নশীল ও দৃঢ়ব্রত হইয়া ভক্তিপূর্বক সর্বদা আমার কীর্তন এবং বন্দনা করিয়া নিত্য সমাহিত চিত্তে আমার উপাসনা করেন ।”

৷৷ ওঁ শ্রীকৃষ্ণার্পণমস্তু ৷৷

শনিবার, ১০ মার্চ, ২০১৮

স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী VS শ্রী অরবিন্দ

( ঋষী শ্রী অরবিন্দ )
(স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী) 


                   বেদ ভাষ্য প্রসঙ্গ

আর্যসমাজ অনুসারী নবীন বালকগুলো শ্রীঅরবিন্দের কথা দিয়ে দয়ানন্দের বেদভাষ্যের প্রসংশা কুড়াতে চায় ৷ তারা সচারচর অরবিন্দের এই কথাটি ব্যবহার করে—

“বেদ ব্যাখ্যার ব্যাপারে আমি নিশ্চিত যে বেদের চূড়ান্ত পরিপূর্ণ ব্যাখ্যা যাই হোক না কেন, দয়ানন্দ সম্মানিত হবেন প্রথম সঠিক সূত্র আবিষ্কারক হিসেবে ৷” এইকথাতে কিন্তু স্পষ্ট যে দয়ানন্দের বেদ-ব্যাখ্যা চূড়ান্ত তথা নির্ভুল না ৷ কারণ হিসেবে বলা যায় যে, দয়ানন্দের বেদভাষ্যে ক্রম-ভঙ্গ দোষ দেখা যায় ৷ তার ঋগ্বেদ ভাষ্যের অনেক স্থলেই দেখা যায় যে, কোন সূক্তের একটি মন্ত্রকে ঈশ্বরপক্ষে ব্যাখ্যা করলেও ঠিক পরের মন্ত্রটিকে একইভাবে ঈশ্বরপক্ষে ব্যাখ্যা করতে তিনি সক্ষম হননি ৷ এই ক্রম-ভঙ্গ দোষ দেখে, ধর্মানন্দ সরস্বতী সেসব স্থলে নিজে আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন ৷
(উদাহরণস্বরূপ- দয়ানন্দ কৃত ঋগ্বেদ ভাষ্যের ধর্মানন্দ সরস্বতী কৃত ইংরেজি অনুবাদ, ১ম খন্ড, পৃঃ ১৬২ দেখুন)


শ্রীঅরবিন্দ দয়ানন্দের বেদভাষ্য সম্পর্কে আবার বলেছেন ৷—

“দয়ানন্দ বেদের যে ব্যাখ্যা করেছে তা এই ধারণা দ্বারা শাসিত হয়েছে যে বেদ হলো আধ্যাত্মিক, নৈতিক ও বৈজ্ঞানিক সত্যের এক সর্বাঙ্গীন প্রকাশ ৷” বেদ আধ্যাত্মিক, নৈতিক ও বৈজ্ঞানিক সত্যের ভান্ডার— একথাগুলো বেশ ভালো, কিন্তু আমাদের বক্তব্য এই যে, বেদের প্রকৃত সত্য নির্ণয় করতে হলে বেদ ঠিক যেরুপ সেইরুপই ব্যাখ্যা করা উচিত, নিজস্ব কোন ধ্যান-ধারণার বশবর্তী হয়ে বেদ ব্যাখ্যা করতে গেলে সেইসব ধ্যান-ধারণারই অনুবাদ হয়, প্রকৃত সত্য নির্ণয় হয় না ৷ যাহোক, শ্রী অরবিন্দ বলেছেন যে দয়ানন্দের মতবাদ অনুসারে - “বেদের আধ্যাত্মিক তত্ত্ব হলো একেশ্বরবাদ ও বৈদিক দেবতারা হলেন এক দেবের বিভিন্ন বর্ণনাত্মক নামমাত্র ৷” দয়ানন্দ দেবতাদের রূপ স্বীকার করত না, দয়ানন্দের এইরুপ মতবাদের বিরুদ্ধে শ্রীঅরবিন্দ বলেন— “সত্য বটে ঋগ্বেদ নিজেই বলেছে যে দেবতারা হলেন এক বিশ্বাত্মক সৎ-এর বিভিন্ন নাম ও প্রকাশ, যিনি আবার বিশ্বকে অতিক্রম করেও আপন স্বরুপে অবস্থান করেন ৷ কিন্তু সূক্তগুলোর বক্তব্য থেকে আমরা এই উপলব্ধি করতেও বাধ্য যে শুধু নামই নয়, দেবতারা হলেন এক সত্তার রূপ, শক্তি ও ব্যষ্টি প্রকাশ ৷ বেদের একেশ্বরবাদে অদ্বৈতবাদ, সর্বেশ্বরবাদ, বহুদেবতাবাদও অন্তর্ভূক্ত ৷ যদি আমরা বেদের মন্ত্রগুলোর সাথে প্রবল ধ্বস্তাধ্বস্তি করি, তাহলেই শুধু তার ওপর আমরা (দয়ানন্দের মতো) একটি কম জটিল মতবাদ জোর করে চাপাতে পারি ৷”
এইকথাতে স্পষ্টই অনুমান করা যায় যে, দয়ানন্দ তার নিজস্ব মতবাদকে বেদের ওপর চাপাতে গিয়ে বেদমন্ত্রের অর্থ কতটা টানা-হেঁচড়া করেছে ৷ শ্রী অরবিন্দ কপালী শাস্ত্রী ইনস্টিটিউট এর বেদভাষ্যকার R L Kashyap তার ঋগ্বেদ ভাষ্যের শেষে লিখেছেন— “দয়ানন্দ একই শব্দের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন অর্থ করেছে, যাতে করে তিনি কোন মন্ত্রের যেরুপ অর্থ আকাঙ্ক্ষা করেন, সেরুপ অর্থই বানাতে পারেন ৷” অর্থাৎ দয়ানন্দের বেদভাষ্য হচ্ছে তার নিজস্ব মতবাদের ভাষ্য ৷



             ন তস্য প্রতিমা অস্তি - প্রসঙ্গ

দয়ানন্দ ‘ন তস্য প্রতিমা অস্তি’ (যজুর্বেদ ৩২/৩) দ্বারা দাবি করেন যে প্রতিমাপূজা বেদবিরোধী ৷ শ্রীঅরবিন্দ কপালী শাস্ত্রী ইনস্টিটিউট হতে প্রকাশিত ‘যজুর্বেদ’ নামক আর্টিকেলে সরাসরি দয়ানন্দের নাম উল্লেখ তার দাবির বিরোধীতা করা হয়েছে এবং সঠিক অনুবাদ তুলে ধরা হয়েছে ৷



                   সম্ভূতি অসম্ভূতি প্রসঙ্গ

অন্ধং তমঃ প্রবিশন্তি যেহসংভূতিমুপাসতে।
ততো ভুয় ইব তে তমো য উ সম্ভূত্যাঃ রতাঃ।।
যজুর্বেদ ৪০/৯) দয়ানন্দ ইহার এই অর্থ লিখেছে -
“যাহারা ব্রহ্মের স্থানে ‘অসম্ভতি’ অর্থাৎ অনুৎপন্ন অনাদি প্রকৃতি কারণের উপাসনা করে, তাহারা অন্ধকার অর্থাৎ অজ্ঞানতা এবং দুঃখসাগরে নিমগ্ন হয়। আর যাহারা ব্রহ্মের স্থানে ‘সম্ভূতি’ অর্থাৎ কারণ হইতে উৎপন্ন কার্যরূপ পৃথিব্যাদি ভূত, পাষাণ ও বৃক্ষাদির অবয়ব এবং মনুষ্যাদির শরীরের উপাসনা করে, তাহারা উক্ত অন্ধকার অপেক্ষাও অধিকতর অন্ধকার অর্থাৎ মহামূর্খ চিরকাল ঘোর দুঃখরূপ নরকে পতিত হইয়া মহাক্লেশ ভোগ করে।”
(সত্যার্থ প্রকাশ, ১১শ সমুল্লাস দেখুন)

সমীক্ষাঃ  যজুর্বেদ ৪০/১১ নং মন্ত্রে আছে ‘সম্ভূত্যাহমৃতমশ্নুতে’ অর্থাৎ সম্ভূতি দ্বারা অমৃতত্ব লাভ হয় ৷ তাহলে দয়ানন্দের ভাষ্য অনুযায়ী বলতে হয়— যারা ‘সম্ভূতি’ অর্থাৎ কারণ হইতে উৎপন্ন কার্যরূপ পৃথিব্যাদি ভূত, পাষাণ ও বৃক্ষাদির অবয়ব এবং মনুষ্যাদির শরীরের উপাসনা করে, তারা অমৃতত্ব লাভ করে ৷ কিন্তু দয়ানন্দ ইহার  বিরোধীতা করেছেন ৷ এজন্যই কি তিনি নিজেই ঘোর দুঃখরূপ নরকে পতিত হইয়া মহাক্লেশ ভোগ করিলেন? তিনি পরলোকের বাহ্যিক স্বর্গ-নরক মানতেন না, এইজন্যই কি জীবদ্দশাতেই তাকে ধুঁকে ধুঁকে মরতে হলো? কেন তিনি বিষের যন্ত্রণারূপ নরকে পতিত হইয়া তিলে তিলে মৃত্যুযন্ত্রণা ভোগ করে মারা গেলেন, পবিত্র বেদের এইরুপ বিকৃত অর্থ করার জন্যই কি?
যজুর্বেদ ৪০/৯-১১ মন্ত্র তিনটির শ্রীঅরবিন্দ কৃত অনুবাদ ও ব্যাখ্যা (ঈশোপনিষদ ১২-১৪ হতে) দেখুন ৷—

অন্ধং তমঃ প্রবিশন্তি যেহ’সম্ভূতিমুপাসতে ৷
ততো ভূয়া ইভ তে তমো য উ সম্ভূত্যাং রতাঃ ৷৷
Into a blind darkness they enter who follow after the Non-Birth, they as if into a greater darkness who devote themselves to the Birth alone.
অন্যদেবাহুঃ সম্ভবাদন্যদাহুরসম্ভাৎ ৷ 
ইতি শুশ্রুম ধীরাণাং যে নস্তদ্বিচচক্ষিরে ৷৷
Other, verily, it is said, is that which comes by the Birth, other that which comes by the Non-Birth; this is the lore we have received from the wise who revealed That to our understanding.
সম্ভূতিং চ বিনাশঞ্চ যস্তদ্বেদোভয়ং সহ ৷
বিনাশেন মৃত্যুং তীর্ত্বা সম্ভূত্যাহ’মৃতমশ্নুতে ৷৷
He who knows That as both in one, the Birth and the dissolution of Birth, by the dissolution crosses beyond death and by the Birth enjoys Immortality.

ব্যাখ্যাঃ প্রকৃতির বাইরে আত্মার চলনা বা ভূতি হয় না। আত্মা অপরিবর্তনীয় ও সনাতন। প্রকৃতির মধ্যে আত্মা বিভিন্ন নামরূপে ও বিভিন্ন অবস্থায় প্রকাশিত হয়। আত্মার দুটি অবস্থা-- একটি সর্বগত, অপরটি সর্বাতীত; একটি প্রকৃতিতে গতিশীল, অপরটি প্রকৃতির ঊর্ধে স্থিত। আত্মার এই দুটি অবস্থার জন্যই মানবীয় চেতন সত্তার দুটি ভাব দেখা যায়। একটি জন্ম বা 'সম্ভূতি', অপরটি অজন্ম বা 'অসম্ভূতি'। মানুষ জন্মের বিক্ষুব্ধ অবস্থা থেকে যাত্রা করে এবং ক্রমে এই গতি থেকে মুক্ত হয়ে চেতনসত্তার যে নিষ্ক্রিয় শান্ত অবস্থা তাতে পৌঁছায়-- এটাই 'অসম্ভূতি'। প্রকৃতিতে জন্মের গ্রন্থি হচ্ছে অহং জ্ঞান। এই অহং জ্ঞান বিনষ্ট হলে মানুষ অসম্ভূতির অবস্থা প্রাপ্ত হয়। এই কারণেই অসম্ভূতিকে বলা হয়েছে বিনাশ। সম্ভূতি ও অসম্ভূতি দৈহিক অবস্থা নয়, আত্মিক অবস্থা। অহং জ্ঞানের গ্রন্থি ছেদ করেও কোন লোক জড় দেহে থাকতে পারে। কিন্তু সে যদি অহং জ্ঞানের বিনাশের উপর চিত্তকে সমাহিত করতে পারে তবে তার আর জড় দেহে জন্ম হয় না। প্রকৃতির প্রেরণায় গঠিত বর্তমান দেহ শেষ হলে সে মুক্ত হয়ে যায়। অন্যদিকে সে যদি সম্ভূতিতেই আসক্ত হয় তবে তার অহং- সত্তা সর্বদাই নতুন নতুন দৈহিক ও মানসিক রূপে প্রকাশ পাবার চেষ্টা করে। সম্ভূতি বা জন্মের অবস্থার উপর আসক্তির অর্থ আত্মাকে ক্রমাগত সীমাবদ্ধ করা এবং আমিত্ব বোধের নিম্ন থেকে নিম্নস্তরে জন্মগ্রহণ। এই অবস্থা থেকে উন্নততর অবস্থা লাভ বা মুক্তিলাভের কোন সম্ভাবনা থাকে না। এই অবস্থা অজ্ঞানের অন্ধকার থেকেও গভীর। কারণ এই অবস্থায় মুক্তির যে প্রেরণা তাও নষ্ট হয়ে যায়। সম্ভূতিকে (জন্মকে) তাই উন্নতি ও আত্মপ্রসারণের উপায় রূপে গ্রহণ করে মহত্তর পূর্ণতর জীবন লাভের পথে চলা ও ক্রমে তাই চরম লক্ষ্য সাধনের সিঁড়ি হয়ে উঠে।
ব্রহ্ম একদিকে বিদ্যা-- অপরদিকে অবিদ্যা; একদিকে সম্ভূতি, অন্যদিকে অসম্ভূতি। প্রকৃতির মধ্যে মুক্ত দিব্যজীবন লাভ করতে হলে আত্মাকে জন্মহীন মৃত্যুহীন উপলব্ধি করে অনন্ত সর্বাতীত সত্তার মধ্যে জন্মমৃত্যুর দ্বন্দ্বাতীত যে সাম্যাবস্থা তাই লাভ করতে হবে। অক্ষর ব্রহ্মের যে শুদ্ধ একত্ব তাতে স্থিতি লাভ করতে পারলেই এই চলমান প্রকৃতির স্রোতে ডুবে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে না। এই ভাবেই মানুষ মুক্ত হয়ে ব্রহ্মের সঙ্গে এক বোধ করে। তার কাছে সম্ভূতি- অসম্ভূতি ব্রহ্মের সত্তার বিভিন্ন অবস্থা মাত্র। সাধক তখন প্রকৃতির মোহতে আবদ্ধ হন না এবং প্রকৃতির মধ্যেই অমৃতত্ব লাভ করেন। জন্মের আর প্রয়োজন থাকে না তখন, কারণ তার ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য সাধিত হয়েছে। কিন্তু সম্ভূতি বা জন্মের স্বাধীনতা তার বর্ত্তমান থাকে। কারণ পরমপুরুষ তাঁর চিরন্তন সত্তার স্বাধীনতা ও সম্ভূতির স্বাধীনতা উভয়ই তিনি একসঙ্গে এবং সমানভাবে ভোগ করেন।
এই রকমই আমিত্বের আসক্তি বিনাশ দ্বারা আত্মা মৃত্যুকে অতিক্রম করে এবং সব রকম দ্বন্দ্বের সীমাবন্ধন থেকে মুক্ত হয়। মুক্তিলাভের পর জীব সম্ভূতিকে আত্মার অধীন ক্রিয়ারূপে গ্রহণ করে, আত্মাকে প্রকৃতির অধীন করে না এবং এই মুক্ত দিব্য সম্ভূতি দ্বারা অমৃতত্ব ভোগ করে।


              সাকার নিরাকার প্রসঙ্গ

দয়ানন্দ বলেন, ঈশ্বর কেবল নিরাকার, তাঁর সাকার হওয়ার ক্ষমতা নেই ৷ যদি তিনি সাকার হন, তবে তিনি একদেশী, সসীম হবেন, সর্বব্যাপী হতে পারবেন না ৷ এইরুপ অল্পবুদ্ধির অজ্ঞানপ্রসূত মন্তব্যের বিপরীতে শ্রীঅরবিন্দ বলেন— “ভগবান বন্ধনরহিত, তিনি নিরাকার ও সাকার, সাধককে সাকার হইয়া দর্শন দেন— সেই আকারে পূর্ণ ভগবান রহিয়াছেন, অথচ সেই একই সময়ে সমগ্র ব্রক্ষান্ড ব্যাপিত হইয়া আছেন। কেননা ভগবান দেশকালাতীত, অতর্কগম্য, দেশ ও কাল তাঁহার খেলার সামগ্রী। তিনি এই দেশ ও কালরুপ জাল ফেলিয়া সর্বভূতের সাথে ক্রীড়া করিতেছেন, আমরা কিন্তু তাঁহাকে সেই জালে ধরিতে পারিব না। যতবার তর্ক ও দার্শনিক যুক্তি প্রয়োগ করিয়া সেই অসাধ্য সাধন করিতে যাই, ততবার রঙ্গময় সেই জালকে সরাইয়া আমাদের অগ্রে, পিছনে, পার্শ্বে, দূরে, চারদিকে মৃদু মৃদু হাসিয়া বিশ্বরুপ ও বিশ্বাতীত রুপ প্রসার করিয়া আমাদের বুদ্ধিকে পরাস্ত করেন ৷”




শনিবার, ৩ মার্চ, ২০১৮

বৈদিক ঋষির কৃষ্ণ দর্শন




জগতের স্রষ্টা বলে কি কেউ আদৌ আছেন? যদি থাকেন, তবে সেই জগদীশ্বর শ্রীভগবানকে কি দর্শন করা যায়? কেউ কি তাঁকে প্রত্যক্ষ করেছে? নতুবা এ কেবলই অন্ধবিশ্বাস? যারা বলে ঈশ্বর নিরাকার ও তাঁকে দেখা যায় না, তারা কেবল অন্ধবিশ্বাসের ওপরই জীবন ব্যয় করছে ছাড়া আর কি? কিন্তু বৈদিক সনাতন ধর্ম অন্ধবিশ্বাসের ওপর প্রতিষ্ঠিত নয়, বেদদ্রষ্টা ঋষিগণ পরমেশ্বরের সাক্ষাৎ প্রাপ্ত হয়েছিলেন ৷ ভগবদ্ভক্ত সাধক ভগবানের দর্শন প্রাপ্ত হন, ইহা নিত্য সত্য ব্যাপার ৷ ইহার দৃষ্টান্ত তাই বেদে দেখতে পাই —
.
“নেম ঋষি বলেন, ইন্দ্র নামে কেউ নেই! কে তাকে দেখেছে? আমরা কাকে স্তুতি করব?” (ঋঃ ৮৷১০০৷৩)
পরমৈশ্বর্যবান ভগবান (ইন্দ্র) তার সম্মুখে আবির্ভূত হয়ে বলছেন— “হে স্তোতা, এ আমি তোমার নিকট এসেছি, আমাকে দর্শণ কর ৷ সমস্ত ভুবনকে আমি মহিমা দ্বারা অভিভূত করি ৷ যজ্ঞের প্রদেষ্টৃগণ আমাকে বর্ধিত করে, আমি বিদারণশীল ভূমি বিদীর্ণ করি ৷” (ঋঃ ৮৷১০০৷৪)
.
(এখানে দয়ানন্দ অনুরাগী বালকগুলো হয়ত জয়দেব শর্মার গাঁজাখুরি অনুবাদ দেখাবে ৷ কিন্তু ঐ গাঁজাখুরি অনুবাদ যে ভুল তার প্রমাণ—)
.
 মহর্ষি শৌণক (৮৷১০০) এই সূক্ত প্রসঙ্গে বলেছেন যে- ‘ভৃগুপুত্র নেম বলেছিলেন ইন্দ্র বলতে কেউ নাই ৷ একথা শুনে ইন্দ্র তার সম্মুখে আবির্ভূত হয়ে তাকে দর্শন দেন এবং ৪ ও ৫ নং মন্ত্র স্বয়ং ইন্দ্রের বাক্য ৷ নেম ঋষি ইদ্রদেবকে দর্শন করে যার পর নাই আনন্দিত হন ৷’ (বৃহদ্দেবতা ৬/১১৭-১১৯)
.
ভগবদ্দর্শনের আরো একটি স্পষ্ট স্বীকারোক্তি পাই ৷—
.
ঋগ্বেদ সংহিতা
মন্ডল-১ ৷ সূক্ত-২৫ ৷ মন্ত্র-১৮
দেবতা- বরুণ ৷ ঋষি- শুনঃশেপ
.
দর্শং নু বিশ্বদর্শতং দর্শং রথমধি ক্ষমি ৷
এতা জুষত মে গিরঃ ৷৷
.
সায়ণভাষ্যঃ (বিশ্বদর্শতং) সর্ব্বজন-দর্শনীয়, এবং আমাদিগের প্রতি কেবল অনুগ্রহের নিমিত্ত আবির্ভূত বরুণদেবকে (দর্শং নু) আমি নিশ্চিতভাবে দেখিয়াছি ; এবং (দর্শং রথমধি ক্ষমি) এই ভূমি তথা পৃথিবীতে বরুণদেবের রথকে প্রকাশ্যভাবে দেখিয়াছি, (এতা মে গিরঃ) আর আমি যেসমস্ত স্তুতি উচ্চারণ করিতেছি, সেই বরুণদেব আমার সেই সমস্ত স্তুতি (জুষত) সেবা অর্থাৎ গ্রহণ করিয়াছেন ৷
 ‘দর্শং’ এই পদটি ‘ইরিতো বা’ (পাণিনি ৩৷১৷৫৭) এই সূত্রানুসারে ‘চির’ স্থানে ‘অঙ’ আদেশ এবং ‘ঋদৃশোহঙি গুণঃ’ (পাণিনি ৭৷৪৷১৬) এই সূত্র দ্বারা গুণ করিয়া সিদ্ধ হইয়াছে ৷ ‘বিশ্বদর্শতং’ এই পদে ‘দৃশ’ ধাতুর উত্তর ‘ভৃমৃদৃশি’ ইত্যাদি সূত্র দ্বারা ‘অতচ্’ প্রত্যয় দ্বারা ‘দর্শত’ পদ নিষ্পন্ন হইয়াছে ৷  ...... অথবা বিশ্ব অর্থাৎ সমস্ত দর্শনীয় হয় ইহার— এইরুপ বহুব্রীহি সমাস হইলে ‘বিশ্বং সংজ্ঞায়াম’ (পাণিনি ৬৷২৷১০৬)..... ৷
.
(হে মনুষ্য! রথে উপবিষ্ট ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে কি তুমি দেখ নাই?)
.
শ্রীদূর্গাদাস লাহিড়ী শর্ম্মন এইরুপ অনুবাদ করেছেন :—
“সেই সর্ব্বদর্শী ভগবানকে আমি নিশ্চয় দেখিয়াছি ; পৃথিবীতে তাঁহার গতিবিধি সম্যকরূপে আমার দৃষ্টিগোচর হইয়াছে ৷ আমার উচ্চারিত স্তোত্রসমুদায় তাঁহার নিকট পৌছয়াছে (তিনি আমার স্তোত্রসমুদায় প্রাপ্ত হইয়াছেন)৷”
.
সায়ণ ভাষ্য মানি না, বা দূর্গাদাসকে চিনি না ইত্যাদি বলে অনেকে পালানোর পথ খুঁজতে পারে, তাদের জন্য আর্যসমাজী সত্য প্রকাশ সরস্বতী কৃত অনুবাদ দিলাম :—
“ I have seen Him whom all may see. I am feeling the presence of His divine chariot above the earth—His activity around us—I am sure that He has accepted my devotional songs. ”
.
(যেখানে সকলের অনুবাদেই মূল বিষয়ে সাদৃশ্য রয়েছে, সেখানে দয়ানন্দ এই মন্ত্রের কিরুপ গাঁজাখুরি অর্থ করেছে তা সকলে নিজ দায়িত্বে দেখে নিবেন)
.

হে কৃষ্ণ “বায়ু, যম, অগ্নি, বরুণ, তুমিই ৷ পিতামহ ব্রহ্মাও তুমি এবং ব্রহ্মার জনকও তুমি ৷ তোমাকে সহস্র বার নমস্কার করি, আবারও পুণঃ পুণঃ তোমাকে নমস্কার করি ৷” (গীতা ১১/৩৯)
.
তুমি স্বয়ংই বলেছো—
“বেদৈশ্চ সর্বৈরহমেব বেদ্যো বেদান্তকৃদ্ বেদবিদেব চাহম্”
অর্থাৎ, আমিই সমস্ত বেদের জ্ঞাতব্য এবং আমিই বেদান্তকর্তা ও বেদবিৎ (১৫/১৫)৷

.
এইবার প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের ভগবদ্দর্শনের উপায় কি?
.

মহর্ষি পাতঞ্জল বলেছেন— “স্বাধ্যায়াদিষ্টদেবতাসম্প্রয়োগঃ” ৷৷
অর্থ—‘সাধ্যায় দ্বারা ইষ্টদেবতার দর্শন (সাক্ষাৎকার) হয় ৷’ [যোগদর্শন ২/৪৪]

এবং দেবর্ষি নারদ (ভক্তিসূত্র- ৮০) বলেছেন—
‘স কীর্ত্যমানঃ শীঘ্রমেবাবির্ভবতি অনুভাবয়তি চ ভক্তান্‘৷৷
অর্থ—“ভজনায় তুষ্ট ভগবান শীঘ্রই (ভক্তের নিকট) আবির্ভূত হন এবং ভক্তদের তাঁর অনুভব করতে দেন ৷”
.
৷৷ ওঁ শ্রীকৃষ্ণার্পণমস্তু ৷৷



শুক্রবার, ২ মার্চ, ২০১৮

বৈদিক ঋষির ঈশ্বর দর্শন


জগতের স্রষ্টা বলে কি কেউ আদৌ আছেন? যদি থাকেন, তবে সেই জগদীশ্বর শ্রীভগবানকে কি দর্শন করা যায়? কেউ কি তাঁকে প্রত্যক্ষ করেছে? নতুবা এ কেবলই অন্ধবিশ্বাস?
বৈদিক সনাতন ধর্ম অন্ধবিশ্বাসের ওপর প্রতিষ্ঠিত নয়, বেদদ্রষ্টা ঋষিগণ পরমেশ্বরের সাক্ষাৎ প্রাপ্ত হয়েছিলেন ৷ ভগবদ্ভক্ত সাধক ভগবানের দর্শন প্রাপ্ত হন, ইহা নিত্য সত্য ব্যাপার ৷ ইহার দৃষ্টান্ত তাই বেদে দেখতে পাই —

“নেম ঋষি বলেন, ইন্দ্র নামে কেউ নেই! কে তাকে দেখেছে? আমরা কাকে স্তুতি করব?” (ঋঃ ৮৷১০০৷৩)
পরমৈশ্বর্যবান ভগবান (ইন্দ্র) তার সম্মুখে আবির্ভূত হয়ে বলছেন— “হে স্তোতা, এ আমি তোমার নিকট এসেছি, আমাকে দর্শণ কর ৷ সমস্ত ভুবনকে আমি মহিমা দ্বারা অভিভূত করি ৷ যজ্ঞের প্রদেষ্টৃগণ আমাকে বর্ধিত করে, আমি বিদারণশীল ভূমি বিদীর্ণ করি ৷” (ঋঃ ৮৷১০০৷৪)


 শ্রীপাদ দামোদর সাতবলেকর কৃত হিন্দী ‘সুবোধ ভাষ্য’তেও একই অর্থ প্রকাশিত হয়েছে ৷ দেখুন,



মহর্ষি শৌণক (৮৷১০০) এই সূক্ত প্রসঙ্গে বলেছেন যে- ‘ভৃগুপুত্র নেম বলেছিলেন ইন্দ্র বলতে কেউ নাই ৷ একথা শুনে ইন্দ্র তার সম্মুখে আবির্ভূত হয়ে তাকে দর্শন দেন এবং ৪ ও ৫ নং মন্ত্র স্বয়ং ইন্দ্রের বাক্য ৷ নেম ঋষি ইদ্রদেবকে দর্শন করে যার পর নাই আনন্দিত হন ৷’ (বৃহদ্দেবতা ৬/১১৭-১১৯)


ভগবদ্দর্শনের আরো একটি স্পষ্ট স্বীকারোক্তি পাই ৷—

ঋগ্বেদ সংহিতা
মন্ডল-১ ৷ সূক্ত-২৫ ৷ মন্ত্র-১৮
দেবতা- বরুণ ৷ ঋষি- শুণঃশেপ


দর্শং নু বিশ্বদর্শতং দর্শং রথমধি ক্ষমি ৷
এতা জুষত মে গিরঃ ৷৷


সায়ণভাষ্যঃ (বিশ্বদর্শতং) সর্ব্বজন-দর্শনীয়, এবং আমাদিগের প্রতি কেবল অনুগ্রহের নিমিত্ত আবির্ভূত বরুণদেবকে (দর্শং নু) আমি নিশ্চিতভাবে দেখিয়াছি ; এবং (দর্শং রথমধি ক্ষমি) এই ভূমি তথা পৃথিবীতে বরুণদেবের রথকে প্রকাশ্যভাবে দেখিয়াছি, (এতা মে গিরঃ) আর আমি যেসমস্ত স্তুতি উচ্চারণ করিতেছি, সেই বরুণদেব আমার সেই সমস্ত স্তুতি (জুষত) সেবা অর্থাৎ গ্রহণ করিয়াছেন ৷

শ্রীদূর্গাদাস লাহিড়ী শর্ম্মন এইরুপ অনুবাদ করেছেন :—
“সেই সর্ব্বদর্শী ভগবানকে আমি নিশ্চয় দেখিয়াছি ; পৃথিবীতে তাঁহার গতিবিধি সম্যকরূপে আমার দৃষ্টিগোচর হইয়াছে ৷ আমার উচ্চারিত স্তোত্রসমুদায় তাঁহার নিকট পৌছয়াছে (তিনি আমার স্তোত্রসমুদায় প্রাপ্ত হইয়াছেন)৷”


স্বামী সত্য প্রকাশ সরস্বতী কৃত অনুবাদ :—
“ I have seen Him whom all may see. I am feeling the presence of His divine chariot above the earth—His activity around us—I am sure that He has accepted my devotional songs. ”
শ্রীঅরবিন্দ কপালী শাস্ত্রী ইনস্টিটিউট হতে প্রকাশিত ঋগ্বেদ হতে অনুবাদ ও মন্তব্যও দেখুন—


এছাড়া, মহর্ষি পাতঞ্জল বলেছেন— “স্বাধ্যায়াদিষ্টদেবতাসম্প্রয়োগঃ” ৷৷
অর্থ—‘সাধ্যায় দ্বারা ইষ্টদেবতার দর্শন (সাক্ষাৎকার) হয় ৷’ [যোগদর্শন ২/৪৪]


এবং দেবর্ষি নারদ (ভক্তিসূত্র- ৮০) বলেছেন—
‘স কীর্ত্যমানঃ শীঘ্রমেবাবির্ভবতি অনুভাবয়তি চ ভক্তান্‘৷৷
অর্থ—“ভজনায় তুষ্ট ভগবান শীঘ্রই (ভক্তের নিকট) আবির্ভূত হন এবং ভক্তদের তাঁর অনুভব করতে দেন ৷”


≈ Om Hari Om ≈



সাম্প্রতিক পোস্ট

পুরুষ—কৃষ্ণ ৷৷ প্রকৃতি—রাধা

 পুরুষ—কৃষ্ণ ৷৷ প্রকৃতি—রাধা ======================= যোগেনাত্মা সৃষ্টিবিধৌ দ্বিধারূপো বভূব সঃ ৷ পুমাংশ্চ দক্ষিণার্ধাঙ্গো বামাঙ্গঃ প্রকৃতিঃস্...

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ