বৃহস্পতিবার, ২৫ জানুয়ারী, ২০১৮

গৌড়ীয় বৈষ্ণব-দর্শন : অচিন্ত্যভেদাভেদ-বাদ


শ্রীশ্রীরাধাগোবিন্দ নাথ সম্পাদিত -
                  “গৌড়ীয় বৈষ্ণব-দর্শন”
           দ্বিতীয় খন্ড—অচিন্ত্যভেদাভেদ-বাদ
(আলোচ্য  বিষয়ঃ ব্রহ্মসূত্র, উপনিষদ, শ্রীমদ্ভগবদগীতা)

[ Pdf Download Link : ( Click here ) ]

ওঁ শ্রীকৃষ্ণার্পণস্তু ৷

ব্রহ্ম প্রতিমা



প্রথমে পড়ুন : ন তস্য প্রতিমা অস্তি - প্রকৃত অর্থ বিশ্লেষণ

রূপং রূপং প্রতিরূপো বভুব
             তদস্য রূপং প্রতিচক্ষণায় ৷
ইন্দ্রো মায়াভিঃ পুরুরূপ ঈয়তে
           যুক্তা হস্য হরয়াঃ শতা দশ ৷৷ঋগ্বেদ ৬.৪৭.১৮৷৷
অনুবাদঃ “রুপে রুপে প্রতিরুপ (তাহার অনুরুপ) হইয়াছেন, সেই ইহার রুপকে প্রতিখ্যাপনের (জ্ঞাপনের) জন্য ৷ ইন্দ্র মায়াসমূহের দ্বারা বহুরুপ প্রাপ্ত হন ৷ যুক্ত আছে ইহার অশ্ব শত দশ (অর্থাৎ সহস্র) ৷”


অগ্নির্যথৈকো ভুবনং প্রবিষ্টো রূপং রূপং প্রতিরূপো বভুব৷
একস্তথা সর্বভূতান্তরাত্মা রূপং রূপং প্রতিরূপো বহিশ্চ৷৷
“অগ্নি যেমন এক হয়েও ভুবনের মধ্যে প্রবেশ করে রুপে রুপে বহুরুপ হয়ে আপনাকে ধরে দিয়েছে, তেমনি সর্বভূতের অন্তরস্থ অন্তরাত্মা এক হয়েও বাহির অবধি ভিন্ন ভিন্ন রুপ গ্রহণ করেছে ৷” (কঠঃ ২৷২৷৯)
.
বায়ুর্যথৈকো ভুবনং প্রবিষ্টো রূপং রূপং প্রতিরূপো বভুব৷
একস্তথা সর্বভূতান্তরাত্মা রূপং রূপং প্রতিরূপো বহিশ্চ৷৷
“বায়ু যেমন এক হয়েও ভুবনের মধ্যে প্রবেশ করে রুপে রুপে বহুরুপ হয়ে আপনাকে ধরে দিয়েছে, তেমনি সর্বভূতের অন্তরস্থ অন্তরাত্মা এক হয়েও বাহির অবধি ভিন্ন ভিন্ন রুপ গ্রহণ করেছে ৷” (কঠঃ ২৷২৷১০)
.
“রূপং রূপং প্রতিরূপো বভুব৷ অয়মত্মা ব্রহ্ম সর্ব্বানুভূঃ৷”
অর্থাৎ তিনি প্রতি বস্তুর রুপ ধারণ করিয়াছেন ৷ এই আত্মাই ব্রহ্ম ৷ তিনি সর্ব্বগত ৷ (বৃহদারণ্যক, ২৷৫৷১৯)
.
একো বশী সর্বভূতান্তরাত্মা একং রূপং বহুধা যঃ করোতি৷
“একক নিয়ন্তা হয়েও এই সর্বভূতের অন্তরাত্মা একই রুপকে বহুধা করে চলেছে ৷” (কঠঃ ২৷২৷১২)
.
“যো বিশ্বস্য প্রতিমানং বভুব” (ঋগ্বেদ ২৷১২৷৯)
অর্থাৎ—তিনি নিখিলের প্রতিমা হইয়াছিলেন ৷


সুতরাং দেখা যাচ্ছে, ন তস্য প্রতিমা অস্তি অর্থাৎ ঈশ্বরের তুল্য কেহ না থাকলেও, ঈশ্বর কিন্তু সকলের তুল্য হইতে পারেন, যেকোন রুপ পরিগ্রহ করতে পারেন ৷ তাই ভক্ত-সাধক ঈশ্বরকে যে-প্রতিমাতেই পূজা করুক না কেন, তিনি সেই মূর্তিরূপেই ভক্তকে দেখা দিবেন ৷
“বায়ু যেমন পার্থিব পঙ্কজাদির গন্ধ, রেণুর বর্ণ ধারণ করিয়া নানাগন্ধ ও রুপবিশিষ্ট হয়, তেমনি সর্বদেহের অন্তর্যামী পরমাত্মা শ্রীভগবান উপাসকের বাসনা অনুযায়ী তাদের সম্মুখে আবির্ভূত হন, সেই পরমেশ্বরই আমার মনোরথ পূর্ণ করুন, অন্য দেবতা আশ্রয়ের প্রয়োজন কি?” (শ্রীমদ্ভাগবত ৬৷৪৷৩৪)
.
নমস্তে দেবদেবেশ! শঙ্খচক্রগদাধর ৷
ভক্তেচ্ছোপাত্তরুপায়­ পরমাত্মন্! নমোহস্তু তে ৷৷
নমঃ পঙ্কজনাভায় নমঃ পঙ্কজমালিনে ৷
নমঃ পঙ্কজনেত্রায় নমস্তে পঙ্কজাঙ্ঘ্রয়ে ৷৷
— “হে দেবদেব, হে সর্বেশ্বর, শঙ্খ-চক্র-গদাধারী আপনাকে নমস্কার ! হে পরমাত্মা, আপনি ভক্তগণের ইচ্ছানুরুপ রুপ ধারণ করিয়া থাকেন, আপনাকে নমস্কার ৷ পদ্মনাভ আপনাকে নমস্কার, পদ্মমালাধারী আপনাকে নমস্কার, কমল-নয়ন আপনাকে নমস্কার, কমল-চরণ আপনাকে নমস্কার ৷” (শ্রীমদ্ভাগবত ১০৷৫৯৷২৫-২৬)


মঙ্গলবার, ২৩ জানুয়ারী, ২০১৮

পরমেশ্বর শ্রীভগবান কি নিরাকার?


স পর্যগাচ্ছুক্রমকায়মব্রণম,
অস্নাবিরং শুদ্ধমপাপবিদ্ধম্ ৷
কবির্মনীষী পরিভূঃ স্বয়ম্ভূর্যাথাতথ্যতোহ’র্থান্, ব্যদধাচ্ছাশ্বতীভ্যঃ সমাভ্যঃ।।
[শুক্লযজুর্বেদ ৪০/৮ (বা, ঈশোপনিষদ-৮)]
(যজুর্বেদ সংহিতা, শ্রীবিজনবিহারী গোস্বামী) 

শ্রীপাদ শঙ্করাচার্য এই মন্ত্রের ভাষ্যে লিখেছেন— ব্রহ্ম ‘অকায়ম্’-শব্দে লিঙ্গশরীরবর্জিত, ‘অব্রণম্’ ও ‘অস্নাবিরম্’ শব্দদ্বয়ে স্থূল-শরীর প্রতিষেধ, ‘শুদ্ধম্’-শব্দে কারণশরীর প্রতিষেধ হইয়াছে ...৷
লিঙ্গদেহ, স্থূলদেহ ও কারণদেহ হইতেছে সংসারী জীবের দেহ, প্রাকৃত; ব্রহ্মের কোনরুপ প্রাকৃত দেহই নাই, তাহাই এ-স্থলে বলা হইল ৷ ইহাদ্বারা ব্রহ্মের অপ্রাকৃত চিন্ময় স্বরুপভূত বিগ্রহ নিষিদ্ধ হয় নাই ৷ এই মন্ত্রের ব্যাখ্যায় ত্রিদণ্ডী স্বামী শ্রীভক্তিহৃদয় বন লিখেছেন—
“তাঁহার ভোগযোগ্য কোন প্রাকৃত স্থূলসূক্ষ্ম শরীর নাই, কিন্তু ব্রহ্ম-পরমাত্মারূপ বৃহৎ ও সূক্ষ্ম অধিষ্ঠান ব্যতীত ভগবৎস্বরুপে অপ্রাকৃত-অপূর্ব্ব-রূপ-লাবণ্য-মাধুর্য্য-বিশিষ্ট নিত্য মধ্যমাকৃতিযুক্ত ৷” (বেদের পরিচয়, পৃঃ ৩৩৬)

ভগবানের দিব্য অপ্রাকৃত সাকার রূপের বর্ণনা উক্ত যজুর্বেদেই আছে ৷ যথাঃ—

নমস্তে রুদ্র মন্যব উতো ত ইষবে নমঃ৷
বাহুভ্যামুত তে নমঃ ৷৷১৬/১৷৷
— “হে দুঃখনাশক জ্ঞানপ্রদ রুদ্র, তোমার ক্রোধের উদ্দেশ্যে নমস্কার, তোমার বাণ ও বাহুযুগলকে নমস্কার করি ৷”
.
যা তে রুদ্র শিবা তনূরঘোরাহ’পাপকাশিনী ৷
তয়া নস্তনুবা শন্তময়া গিরিশন্তাভিচাকশীহি ৷৷১৬/২৷৷
— “হে রুদ্র, তোমার যে  মঙ্গলময়, সৌম্য, পুণ্যপ্রদ শরীর আছে, হে গিরিশ, সে সুখতম শরীরের দ্বারা আমাদের দিকে তাকাও ৷”
.
যামিষুং গিরিশন্ত হস্তে বিভর্ষ্যস্তমে ৷
শিবাং গিরিত্র তাং কুরু মা হিংসীঃ পুরুষং জগৎ৷৷১৬/৩৷৷
— “হে গিরিশ, শত্রুর প্রতি নিক্ষেপের জন্য হস্তে যে বাণ ধারণ করেছ, হে প্রাণিগণের ত্রাতা, তা কল্যাণকর কর, পুরুষ ও জগতের হিংসা করো না ৷”

(যজুর্বেদ সংহিতা, শ্রীবিজনবিহারী গোস্বামী) 
আর্যসমাজী তুলসীরাম শর্মা কৃত অনুবাদও দেখুন-


[ দয়ানন্দ নিরাকরণঃ যজুর্বেদের ষোড়শ অধ্যায়ে স্পষ্টত রূদ্ররুপী ভগবানের সাকার রূপের বর্ণনা পাওয়া গেল ৷ কিন্তু নিরাকারবাদের মোহে আচ্ছন্ন দয়ানন্দ সরস্বতী তার ভ্রান্ত মতবাদ রক্ষা করতে গিয়ে উপর্যুক্ত মন্ত্রগুলোর বিকৃত অর্থ করেছে অর্থাৎ স্বেচ্ছাচারিতা করে ভগবানের সাকাররূপ অস্বীকার করেছে ৷ তিনি ওখানে ‘রুদ্র’ নামটিকে ভগবান-পক্ষে ব্যাখ্যা না করে, তাকে কোন মনুষ্য রাজা বানিয়ে দিয়েছে ৷ কিন্তু এটা ভগবানের সাকাররূপ স্বীকার না করার জন্য দয়ানন্দের ভন্ডামি মাত্র ৷ এস্থলে বর্ণিত রুদ্র যে ঈশ্বর, তা উপনিষদ দ্বারা সমর্থিত হচ্ছে, কারণ যজুর্বেদ ১৬/২-৩ মন্ত্রদুটি শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে (৩/৫-৬) হুবহু গৃহীত হয়েছে ৷ উপনিষদ ব্রহ্মবিদ্যা আলোচনার স্থান, বেদবর্ণিত উক্ত রুদ্র ব্রহ্ম না হলে ব্রহ্মজ্ঞ ঔপনিষদিক ঋষিগণ উপনিষদে তাঁকে ব্রহ্ম হিসেবে বর্ণনা করত না ৷ ব্রহ্মজ্ঞ ঋষিগণ বেদ বেশি বুঝতেন, নাকি কলিকালের নব্য পন্ডিত দয়ানন্দ বেশি বুঝে? দেখুন, রুদ্রের পরিচয়—

একোহি রূদ্রো ন দ্বিতীয়ায় তস্হু-
         র্য ইমাঁল্লোকান্ ঈশত ঈশনীভিঃ ৷
প্রত্যঙ্ জনাংস্তিষ্ঠতি সঞ্চুকোপান্তকালে
            সংসৃজ্য বিশ্বা ভুবনানি গোপাঃ।।
—“রুদ্র অদ্বিতীয়, [ব্রহ্মবিদ্গণ] দ্বিতীয় কাহারও আকাঙ্ক্ষায় ছিলেন না। সেই রূদ্রই এই সমুদয় লোককে স্বীয় শক্তিসহায়ে নিয়মিত করেন। তিনি প্রত্যেক জীবের অন্তর্জামিরূপে অবস্থিত আছেন। তিনি নিখিল বিশ্ব সৃষ্টি করিয়া তাহার পালক হন এবং প্রলয়কালে উহার সংহার করেন।” (শ্বেতাশ্বতর ৩/২)
.
অজাত ইত্যেবং কশ্চিদ্ভীরুঃ প্রতিপদ্যতে।
রুদ্র যত্তে দক্ষিণং মুখং তেন মাং পাহি নিত্যং।
 — “তোমাকে অজাত জেনে কেহ তোমার কাছে আসে আর তার চিত্ত ভয়ব্যাকুল হয় ৷ হে রুদ্র, হে ভীষণ, তোমার সেই যে অন্য হাস্যময় প্রসন্ন মুখমন্ডল, তার মধুর হাসি দিয়ে তুমি আমায় রক্ষা কর সর্বদা ৷” (শ্বেতাশ্বতর ৪/২১)]



আবার, আর্যসমাজ হতে প্রকাশিত, স্বামী সত্যপ্রকাশ সরস্বতী অনুদিত বেদভাষ্যেও ভগবানের দিব্য অঙ্গ স্বীকৃত হয়েছে ৷ উদাহরণস্বরুপ (যজুর্বেদ ৩৩/১৫)—
“O adorable God, may you with your divine ears, please listen to my prayers...”
অর্থাৎ— “হে পূজনীয় ঈশ্বর, অনুগ্রহপূর্বক তুমি তোমার দিব্য কর্ণ দ্বারা আমার প্রার্থনাসমূহ শ্রবণ করো ৷”
আমার প্রার্থনা এই যে, “অদব্ধেন ত্বা চক্ষুষাবপশ্যামি” ৷
“হে ভগবন্! আমার বিভ্রমরহিত নেত্রের দ্বারা আমি যেন আপনাকে দর্শন করিতে সমর্থ হই ৷”
(শুক্লযজুর্বেদ ১/৩০, অনুবাদক- দূর্গাদাস লাহিড়ী)


 সুতরাং দেখা যাচ্ছে, শ্রীবিজনবিহারী গোস্বামী, দূর্গাদাস লাহিড়ী, তুলসীরাম শর্ম্মা ও সত্যপ্রকাশ সরস্বতী— প্রত্যেকের যজুর্বেদভাষ্যেই ঈশ্বরের আকারত্ব স্বীকৃত ৷


মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেবের অমোঘ সত্যবাণী—
“ষড়ৈশ্বর্য-পূণানন্দ-বিগ্রহ যাঁহার ৷
হেন ভগবানে তুমি কহ ‘নিরাকার’ ৷৷
তাঁহার বিভূতি দেহ সব চিদাকার ৷
চিদ্বিভূতি আচ্ছাদিয়া কহে নিরাকার ৷৷”
ইহা যারা জানেন না বা মানেন না তারা নিরাকার ভেবে ভুল করেন ৷ ঈশ্বরের সত্তা, স্বরুপ ও দেহ সবই চিন্ময়, দিব্য অপ্রাকৃত ৷

অন্ধশ্চ বধিরো মূকঃ পঙ্গুঃ পণ্ডো বিনাসিকঃ ৷
ইত্যাদ্যা ব্যঙ্গতা-হেতোর্যা নিন্দা লোকসম্মতাঃ ৷
তা সর্ব্বাশ্চ নিরাকারবাদে কিং ন স্যুরীশ্বরে ৷৷
—যুক্তিমল্লিকা ১/১৪ “ইহলোকে জীবের অঙ্গবিশেষের হীনতাবশতঃ অন্ধ, বধির, মূক, পঙ্গু, নপুংসক, বিনাসিক প্রভৃতি নিন্দা হইয়া থাকে, ব্রহ্মকে নিরাকার বলিলে তাঁহার সর্ব্বাঙ্গ-হীনতাবশতঃ, উক্ত নিন্দাসমষ্টি তাঁহাতেই প্রযুক্ত হইল ৷”

≈ ওম্ হরি ওম্ ≈


আরো পড়ুন - শিব-বিষ্ণুর একত্ব


রবিবার, ৭ জানুয়ারী, ২০১৮

শ্রীমন্ত্র-ভাগবতম্ : বেদে কৃষ্ণকথা


শ্রীমন্ মহাপ্রভু গৌরাঙ্গসুন্দর বলেছেন—
“গৌণ মুখ্য বৃত্তি বা অন্বয় ব্যতিরেকে ৷
বেদের প্রতিজ্ঞা কেবল কহয় কৃষ্ণকে ৷৷”
এই কথা পড়ে প্রথমে আমরা আশ্চর্যান্বিত হই ৷ বেদে কৃষ্ণকথা কই?
অসতাং নিগ্রহার্থায় ধর্ম্মসংরক্ষণায় চ ৷
অবতীর্ণো মনুষ্যাণামজায়ত যদুক্ষয়ে ৷
স এষ ভগবান্ বিষ্ণুঃ কৃষ্ণতি পরিকীর্ত্ত্যতে ৷৷
“সেই ভগবান বিষ্ণুই দুর্জ্জনের নিগ্রহ এবং ধর্ম্মরক্ষার জন্য মনুষ্যমধ্যে অবতীর্ণ হইয়া যদুকুলে জন্মিয়াছিলেন; তাঁহাকেই ‘কৃষ্ণ’ বলা হয় ৷” (বনপর্ব, ২২৬/৬৮)
কিন্তু যখন বুঝলাম কৃষ্ণ আর বিষ্ণু একই, তখন আশ্চর্য হওয়ার কিছুই নেই ৷ কারণ পবিত্র বেদে ভগবান বিষ্ণুর কথা অনেক আছে ৷ সুতরাং বেদে কৃষ্ণকথা আছে ৷ তবে মহাপ্রভু বলেছেন— কেবল কৃষ্ণকথা বলাই বেদের প্রতিজ্ঞা ৷ এই কথা কি করে ঠিক হয় তা চিন্তার বিষয় ৷ কেননা বেদে অগ্নি, ইন্দ্র, বায়ু, বরুণ প্রমুখ দেবতাদের কথা আছে ৷ তাহলে বেদ শুধু কৃষ্ণকথাই বলেছে তা কিরুপে সত্য হয়?
উত্তর এই যে, বেদে যত দেবতাদের কথাই থাকুক, তা মূলত একজনেরই নাম ৷ বেদ কেবল এতজনের কথাই বহু প্রকারে, বহু নামে বলেছে ৷ প্রমান দেখুন, বেদ বলেছে—
১) “একং সদ্বিপ্রা বহুধা বদন্ত্যগ্নিং যমং মাতরিশ্বানমাহুঃ”
—“তিনি এক ও সৎ (নিত্য), তাঁহাকেই জ্ঞানীগণ বিভিন্ন নাম দিয়া থাকেন— তাঁহাকেই অগ্নি, যম, মাতশ্বিরা প্রভৃতি বলা হয় ৷” (ঋগ্বেদ ১/১৬৪/৪৬)
২) “যিনি আমাদিগের পিতা ও জন্মদাতা, যিনি বিধাতা, যিনি বিশ্বভুবনের সকল স্থান অবগত আছেন, যিনি অনেক দেবগণের নাম ধারণ করেন, কিন্তু এক ও অদ্বিতীয়, ভুবনের লোকে তাঁহাকে জানিতে ইচ্ছা করে ৷” (ঋগ্বেদ ১০/৮২/৩)

অর্জুনও বলেছেন, “বায়ু, যম, অগ্নি, বরুণ, তুমিই ৷ পিতামহ ব্রহ্মাও তুমি এবং ব্রহ্মার জনকও তুমি ৷ তোমাকে সহস্র বার নমস্কার করি, আবারও পুণঃ পুণঃ তোমাকে নমস্কার করি ৷” (গীতা ১১/৩৯)

গীতাতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ংই বলেছেন, “আমিই এই জগতের পিতা, মাতা, বিধাতা, পিতামহ”(৯/১৭) এবং—
“বেদৈশ্চ সর্বৈরহমেব বেদ্যো বেদান্তকৃদ্ বেদবিদেব চাহম্”
অর্থাৎ, আমিই সমস্ত বেদের জ্ঞাতব্য এবং আমিই বেদান্তকর্তা ও বেদবিৎ (১৫/১৫)৷

এছাড়া ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা বেদে সরাসরি থাকতে পারে কিনা? অনেকে আপত্তি করেন যে শ্রীকৃষ্ণ দ্বাপর যুগের লোক, অথচ বেদ সৃষ্টির প্রারম্ভে উৎপন্ন, তাহলে বেদে কৃষ্ণকথা কিভাবে থাকতে পারে ৷ এই আপত্তিকারীদের মনে ধারণা যে বেদ যেহেতু সৃষ্টির প্রারম্ভে উৎপন্ন, তাই বেদে কেবল ঐ সময়ের কথা থাকা সম্ভব ৷ যদি তাই-ই হয়, তবে বেদ নিত্য হয় কি করে? বেদ নিত্য তথা সর্বকালের, তাই বেদে অতীত-বর্তমান-ভবিষৎ সকল কালের কথাই থাকা সম্ভব, নতুবা বেদ নির্দিষ্ট সময়কালের মধ্যে পরিছন্ন হয়ে যায় ৷ তাছাড়া গৌড়ীয় আচার্যগণ কৃষ্ণলীলার নিত্যতা প্রতিপাদন করেছেন, অতএব নিত্য বেদে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নিত্যলীলা বর্ণিত থাকবে তা অসম্ভব হয় কি করে?

অতি দুঃখের বিষয় এই যে, শ্রীকৃষ্ণই বেদের একমাত্র জ্ঞাতব্য বিষয় হওয়া সত্ত্বেও প্রচলিত বেদভাষ্যগুলোতে শ্রীকৃষ্ণের কথা উল্লেখ করা হয়নি ৷ তাই আপনাদের সামনে তুলে ধরছি এমন একটি গ্রন্থ যেখানে বেদমন্ত্রে কৃষ্ণলীলা প্রতিপাদন করা হয়েছে ৷ গ্রন্থটি—

শ্রীমন্ নীলকন্ঠ সূরি কৃত ‘শ্রীমন্ত্র-ভাগবতম্’

           ( Pdf Link : Click here to Download )



সাম্প্রতিক পোস্ট

পুরুষ—কৃষ্ণ ৷৷ প্রকৃতি—রাধা

 পুরুষ—কৃষ্ণ ৷৷ প্রকৃতি—রাধা ======================= যোগেনাত্মা সৃষ্টিবিধৌ দ্বিধারূপো বভূব সঃ ৷ পুমাংশ্চ দক্ষিণার্ধাঙ্গো বামাঙ্গঃ প্রকৃতিঃস্...

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ