বৃহস্পতিবার, ৩০ মে, ২০১৯

কৃষ্ণযজুর্বেদ ও ব্রাহ্মণগ্রন্থের বেদত্ব প্রসঙ্গে অবোধ দয়ানন্দ নিবারণ

যজুর্বেদের দুইটি ভাগ ৷ একটি কৃষ্ণযজুর্বেদ বা তৈত্তিরীয় সংহিতা, অপরটি শুক্লযজুর্বেদ বা বাজসনেয় সংহিতা ৷

‘বেদের পরিচয়’ (পৃঃ ৪২) গ্রন্থে ডঃ যোগীরাজ বসু কৃষ্ণযজুর্বেদ সম্পর্কে প্রচলিত একটি মত উল্লেখ করেছেন ৷ যথা:— “কৃষ্ণযজুঃ সংহিতার ও তন্নিষ্ঠ তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণের স্বতন্ত্র সংহিতা ও ব্রাহ্মণের লক্ষণ রক্ষিত হয় নাই।  সংহিতার অনেক অংশ ব্রাহ্মণে পাওয়া যায়,  আবার তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণে সংহিতার অনেক অংশে দৃষ্ট হয়। সংহিতা ও ব্রাহ্মণের সাঙ্কর্য ঘটিয়াছে। এই সাঙ্কর্য বা মিশ্রণ জন্যই ‘কৃষ্ণ’ নাম হইয়াছে। ‘কৃষ্ণ’ শব্দটির সংস্কৃতে একটি অর্থ মিশ্রণ। ব্রাহ্মণ লক্ষণের অভিব্যপ্তি ঘটিয়াছে সংহিতায় এবং সংহিতালক্ষণের বা মন্ত্রলক্ষণের অভিব্যাপ্তি ঘটিয়াছে ব্রাহ্মণে।  অমিশ্রিত যাহা শুদ্ধ, তাহা শুক্ল আর যাহা মিশ্রিত তাহা শুদ্ধ নহে, শুক্ল নহে, তাহা কৃষ্ণ।”
কৃষ্ণযজুর্বেদে মন্ত্র আর ব্রাহ্মণের মিশ্রণ আছে ঠিকই, কিন্তু সে জন্যই যে ইহা ‘কৃষ্ণ’ বা অশুদ্ধ, আর অপরটি শুদ্ধ তা সম্পূর্ণ সঠিক নয় ৷ ইহা প্রচলিত ব্যাখ্যা মাত্র ৷ “কিন্তু এ-ব্যাখ্যা মনে হয় উপরভাসা ৷ শুক্লযজুর্বেদের শতপথব্রাহ্মণের শেষে আছেঃ আদিত্যানীমানি শুক্লানি যজুংষি বাজসনেয় যাজ্ঞবল্কোখ্যায়ন্তে’— বাজসনেয় যাজ্ঞবল্ক্য আদিত্য হতে এই শুক্ল যজুঃ পেয়ে তার ব্যাখ্যা করেছেন ৷ সুতরাং এই যজুর্মন্ত্রগুলি আদিত্যভাবনার দ্বারা ভাস্বর বলেই শুক্ল ৷ একই মন্ত্র ভাবনা এবং তাৎপর্যনিরুপণের দিক থেকে এক সম্প্রদায়ে কৃষ্ণ, আরেক সম্প্রদায়ে শুক্ল ৷…”
—শ্রীঅনির্বাণ (বেদ-মীমাংসা, ১ম খণ্ড, পৃঃ ৬২)

যাহোক, এখন মূল প্রসঙ্গে আসা যাক ৷
কৃষ্ণযজুর্বেদে মন্ত্রভাগ ও ব্রাহ্মণভাগের মিশ্রণ থাকায় কিছুসংখ্যক অবোধ বালক বলছে যে, কৃষ্ণযজুর্বেদ বেদ নয় ৷ কারণ তাদের অবোধ গুরু দয়ানন্দ ব্রাহ্মভাগের বেদত্ব অস্বীকার করে গেছেন ৷ এ প্রসঙ্গে ডঃ যোগীরাজ বসু লিখেছেন :—
“ব্রাহ্মণ গ্রন্থের বেদত্ব আছে কিনা ইহা লইয়া বাদানুবাদ দৃষ্ট হয় ৷ দয়ান্দ সরস্বতী প্রমুখ কেহ কেহ বলেন সংহিতা বা মন্ত্রভাগের বেদত্ব আছে, ব্রাহ্মণের বেদত্ব নাই ৷ অর্থাৎ বেদ বলতে সংহিতা বা মন্ত্র বুঝায়, ব্রাহ্মণ বুঝায় না ৷ কিন্তু এই মত যুক্তিযুক্ত নহে ৷ পূর্বাচার্যগণ ব্রাহ্মণের বেদত্ব স্পষ্টভাষায় স্বীকার করিয়া গিয়াছেন ৷ পূর্বমীমাংসাসূত্রে জৈমিনি ব্রাহ্মণের লক্ষণ করিয়াছেন, ‘শেষে ব্রাহ্মণশব্দঃ’ অর্থাৎ বেদের মন্ত্রভাগ ব্যতীত শেষ অর্থাৎ অবশিষ্ট অংশের নাম ব্রাহ্মণ ৷ এই সূত্রে ব্রাহ্মণের বেদত্ব সুপ্রতিপন্ন ৷ অধিকন্তু বেদের কর্মকাণ্ড লইয়া পূর্বমীমাংসা দর্শন রচিত ৷ এই দর্শনের যতগুলি অধিকরণ, সমস্ত ব্রাহ্মণগ্রন্থের বিষয় ও প্রবচনাদি লইয়া রচিত, সংহিতা প্রবচন লইয়া রচিত নহে ৷ অতএব দয়ানন্দ সরস্বতী যে ব্রাহ্মণগ্রন্থের বেদত্ব অস্বীকার করিয়াছেন তাহা সমীচীন ও যুক্তিযুক্ত নহে ৷” (বেদের পরিচয়, পৃঃ ১৪)


সংহিতা বা মন্ত্রভাগ ও ব্রাহ্মণভাগ একত্র নিয়েই বেদ ৷ এ বিষয়ে প্রমাণ-
✔ “শেষে ব্রাহ্মণশব্দঃ” (পূর্বমীমাংসা বা জৈমিনি সূত্র ২/১/৩৩)
অর্থঃ— বেদের মন্ত্রভাগ ব্যতীত শেষ অর্থাৎ অবশিষ্ট অংশের নাম ব্রাহ্মণ ৷


✔ “মন্ত্রব্রাহ্মণয়োবের্দনামধেয়ম্” (আপস্তম্ব যজ্ঞ-পরিভাষা সূত্র)
অর্থঃ— মন্ত্র ও ব্রাহ্মণভাগের নাম বেদ  ৷


মন্ত্রভাগ ও ব্রাহ্মণ মিলেই বেদ— এই সংজ্ঞার প্রকৃষ্ট প্রমাণ ও নিদর্শনই হচ্ছে কৃষ্ণযজুর্বেদ ৷ কেননা এতে মন্ত্রভাগ ও ব্রাহ্মণ উভয়ই একত্রে সমাবেশিত আছে ৷ যদি ব্রাহ্মণভাগ বেদ না হতো, তাহলে কখনোই পরমপূজ্য বৈদিক ঋষিগণ কৃষ্ণযজুঃ সংহিতাতে ব্রাহ্মণভাগের মিশ্রণ ঘটাতেন না ৷

অবোধদলের আপত্তিঃ অপৌরুষেয় নিত্য বাণীতে কোন মনুষ্যের জীবনকাহিনী বা ইতিহাস থাকবে না। কারণ ইতিহাস তো কোন ব্যক্তির জন্মের পর তার জীবনের কৃত কর্মের উপর ভিত্তি করে লেখা হয়ে থাকে। আর কল্পান্তরে ইতিহাস কখনো এক থাকে না এজন্য ইতিহাস সর্বদা অনিত্য। যেহেতু  বেদ সর্বদা নিত্য , তাই অনিত্যাদি ইতিহাস যুক্তগ্রন্থ বেদ হতে পারে না।

অবোধ নিবারণঃ
শুক্লযজুর্বেদে (৪০/১০) আছে,
ইতি শুশ্রুম ধীরণাং যে নস্তদ্বিচচক্ষিরে৷৷”
অর্থ— ‘এইরুপে শুনেছি ধীরগণের নিকট, যাঁরা উহা আমাদের নিকট ব্যাখ্যা করেছেন’ ৷ অর্থাৎ এই বাক্য যিনি বলেছেন, তিনি অন্যকোন ধীর ঋষির নিকট হতে শুনে তবে ঐ মন্ত্র লিখেছেন ৷ সুতরাং বেদের প্রমাণেই বেদ মনুষ্য রচিত, যাঁরা বেদ রচনা করেছেন তারা ঋষি ৷ মনুষ্যরচিত হলেও বেদককে নিত্য অপৌরুষেয় বলা অসঙ্গত হয়না ৷ কারণ, ‘বেদ’ অর্থ জ্ঞান, বেদ-পুস্তকে যে জ্ঞান নিহিত আছে তাহা নিত্য ৷ কারণ জ্ঞান কখনো সৃষ্টি করা যায় না, কেবল আবিষ্কার করা যায় মাত্র ৷ যেমন- স্যার আইজ্যাক নিউটন ‘মহাকর্ষ সূত্র’ রচনা করেছেন, কিন্তু মহাকর্ষ শক্তি তিনি সৃষ্টি করেন নাই ৷ তিনি কেবল মহাকর্ষ শক্তি আবিষ্কার করেছেন, তিনি তা আবিষ্কারের পূর্বেও মহাকর্ষশক্তি বিদ্যমান ছিল ৷ তেমনিভাবে, ঋষিরা অলৌক দৃষ্টিবলে সত্যজ্ঞানসকল আবিষ্কার করে প্রচলিত ভাষায় মন্ত্র-সূক্ত রচনা করে প্রকাশ করেছেন গেছেন ৷ যেহেতু, ‘বেদ=জ্ঞান’ কোন পুরুষ কতৃক সৃষ্টি হয়না, সেই অর্থে বেদ অপৌরুষেয়ও বটে ৷

পরমপূজ্য ঋষিরা যে জ্ঞান লাভ করেছিলেন, তাহা তারা দেবতাদের স্তব-স্তুতি রচনা মধ্য দিয়ে ব্যক্ত করেছেন এবং সাথে তৎকালীন ইতিহাসও জুড়ে দিয়েছেন ৷ ইতিহাস লেখা হয় কোন ব্যক্তির জন্মের পর ; ‘ইতি শুশ্রুম ধীরণাং যে নস্তদ্বিচচক্ষিরেএই মন্ত্র তো ধীর ঋষিগণের জন্মের পর লেখা, তাঁদের কাছ থেকে শুনে লেখা

অগ্নিঃ পূর্ব্বেভির্ঋষিভিরীড্যো নূতনৈরূত ৷
স দেবা এহ বক্ষতি ৷৷ (ঋগ্বেদ ১/১/২)
—“অগ্নি পূর্ব ঋষিদের স্তুতিভাজন ছিলেন, নুতন ঋষিদেরো স্তুতিভাজন; তিনি দেবগণকে এ যজ্ঞে আনুন ৷” —এই মন্ত্র যে সময়ে উচ্চারিত হয়েছে, তখন বহু ঋষির কাল অতীত হয়ে গিয়েছে ৷

এইকারণে, বেদ-পুস্তকে ইতিহাস থাকা অসম্ভব নয় ৷ প্রকৃত সত্য এই যে, বেদ হচ্ছে হিন্দুজাতির ইতিহাস ৷
সুতরাং ব্রাহ্মণগ্রন্থে ইতিহাস থাকলেও উহা বেদ নামেই অভিহিত হওয়াতে অসঙ্গতি নাই ৷

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

সাম্প্রতিক পোস্ট

পুরুষ—কৃষ্ণ ৷৷ প্রকৃতি—রাধা

 পুরুষ—কৃষ্ণ ৷৷ প্রকৃতি—রাধা ======================= যোগেনাত্মা সৃষ্টিবিধৌ দ্বিধারূপো বভূব সঃ ৷ পুমাংশ্চ দক্ষিণার্ধাঙ্গো বামাঙ্গঃ প্রকৃতিঃস্...

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ